চার্জশিটভুক্ত আসামি হয়েও দায়িত্বে বহাল!

পিডিবি’র প্রকৌশলী আজিমের পাহাড়সম সম্পদ


নিজস্ব প্রতিবেদক ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ১২:৩৭ : অপরাহ্ণ

চট্টগ্রামের হালিশহর চৌচালা মোড় থেকে মিনিট পাঁচেক গেলেই মুনিবনগর সামাজিক কবরস্থান। এর পেছনেই ২২ শতক জমিতে ছয়তলা ভবন। নাম আইয়ুব নিবাস। এর ঠিক পাঁচ গজ দূরেই রশিদা ম্যানশন। এটিও ছয়তলা ফাউন্ডেশনের নির্মাণাধীন ভবন। তিনতলা পর্যন্ত কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চট্টগ্রামের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় জমি কিনে ভবনটি নির্মাণ করেন এসএমএ আজিম। এলাকায় তিনি ইঞ্জিনিয়ার আজিম নামেই পরিচিত। বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগের বিনিময়ে বিপুল অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন পিডিবির এ প্রকৌশলী। বর্তমানে তিনি পূর্তকর্ম বিভাগের ঢাকায় অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

শুধু এ দুই বাড়িই নয়, স্ত্রী নবতারা নূপুরের নামে বেশ কয়েকটি ব্যাংকে নগদ অর্থও রয়েছে। অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের দুর্নীতির কারণেই লোকসান এড়াতে পারছে না বিদ্যুৎ বিভাগ। অবৈধ এ সম্পদ পাচারের শঙ্কাও রয়েছে তদন্তকারী সংস্থাটির।

পিডিবি তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে চট্টগ্রামে দায়িত্ব পালনের সময় প্রায় ৪ কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেন আজিম। নিজেকে আড়ালে রাখতে সেই সম্পদ রেখেছেন স্ত্রীর নামে। নবতারা নূপুরের স্থাবর সম্পদের বেশির ভাগই চট্টগ্রামের হালিশহর আনন্দবাজার এলাকায়। সেখানে তার ছয়তলা বাড়িসহ স্থাবর-অস্থাবর নানা সম্পদ রয়েছে। প্রাথমিক অভিযোগের ভিত্তিতে প্রথমে সম্পদের তালিকা জমা দিতে এ প্রকৌশলীকে নোটিস পাঠায় দুদক।

তিনি সম্পদের বিবরণ জমা দেয়ার পর তদন্তে নামে সংস্থাটি। সেখানে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত বিপুল সম্পদের সন্ধান পেয়ে মামলা করে দুদক। বিস্তর অনুসন্ধানে নবতারা নূপুরের নামে প্রায় ৪ কোটি টাকার স্থাবর ও পৌনে ১ কোটি টাকার অস্থাবর সম্পদের প্রমাণ পাওয়া যায়। এর বাইরে নবতারার ১ কোটি ৬ লাখ টাকার গ্রহণযোগ্য আয়ের তথ্য পাওয়া গেছে।

এ সময় তিনি ব্যয় করেছেন ১৬ লাখ টাকা। ব্যয় বাদে তার নিট সঞ্চয় থাকার কথা প্রায় ৯০ লাখ টাকা। নবতারার নামে থাকা বাকি ৩ কোটি ৮৪ লাখ ৭৪ হাজার ৬০৭ টাকা মূল্যের সম্পদ জ্ঞাত আয়বহির্ভূত। এগুলো তার স্বামী আজিম চাকরির সময়ে দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধভাবে উপার্জন করে স্ত্রীর নামে দিয়েছেন। পাশাপাশি একটি জাল ট্রেড লাইসেন্স দাখিল করে অপরাধও করেন তিনি।

সরেজমিন দেখা যায়, চট্টগ্রাম হালিশহরের আইয়ুব নিবাস নামের ছয়তলা বাড়িটির পুরোটাই ভাড়া দেয়া রয়েছে। আইয়ুব নিবাসের সামনে মূল ফটকের পাশে কথা হয় জামাল উদ্দিন নামের স্থানীয় এক প্রবীণের সঙ্গে। তিনি জানান, মৃত কালা মিয়ার ১০ সন্তানের মধ্যে এসএমএ আজিম পঞ্চম। ২০০৮ সাল-পরবর্তী সময়ে পিডিবির চট্টগ্রামের হালিশহরে দায়িত্ব পালন শুরু করেন আজিম।

পরে তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে চট্টগ্রাম পিডিবিতে দায়িত্ব পালন করেন। সে সময় হালিশহরে তার কোনো সম্পদ ছিল না। এর পরই তিনি পৈতৃক ভিটায় রাশিদা ম্যানশনের নির্মাণকাজ শুরু করেন। এ ভবনের নির্মাণকাজ চলমান থাকা অবস্থায়ই পাশে আরেকটি ছয় কাঠার প্লট কিনে নেন। সেখানে আইয়ুব নিবাস নামের ছয়তলা ভবন নির্মাণ করেন। বর্তমানে এসব জমি কাঠাপ্রতি ৭০ লাখ টাকার ওপরে দাম বলে জানান তিনি।

তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, এসএমএ আজিম চট্টগ্রামের হালিশহরে বাসিন্দা। নিজ এলাকায় চাকরির সুবাধে স্বল্প সময়েই তিনি চট্টগ্রাম পিডিবিতে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। গড়ে তোলেন বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ দেয়ার বিশাল এক সিন্ডিকেট। হালিশহরসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় নিজস্ব লোকজন দিয়ে টাকা সংগ্রহ করে অবৈধ সংযোগ প্রদান করতেন। বিভিন্ন বস্তি ও প্রতিষ্ঠানে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়াই ছিল তাদের কাজ। এছাড়া বকেয়া বিলের বিরুদ্ধে পিডিবির অভিযানকে বাধাগ্রস্ত করে অবৈধ আর্থিক সুবিধা নেয়ার মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়েন আজিম।

অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পাওয়ার পর এসএমএ আজিম ও তার স্ত্রী নবতারা নূপুরের বিরুদ্ধে মামলা করেন দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক হাফিজুল ইসলাম। পরে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় দুদকের সহকারী পরিচালক নুরজাহান পারভীন, উপপরিচালক হাফিজুল ইসলাম এবং উপপরিচালক রফিকুজ্জামানকে। তদন্ত শেষে এসএমএ আজিমের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রটি এখন কর্তৃপক্ষের চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানান মো. রফিকুজ্জামান।

গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, এসএমএ আজিমের জমা দেয়া সম্পদের বিবরণের সঙ্গে বাস্তবের অসামঞ্জস্যতা পাওয়া গেছে। বিশেষ করে চট্টগ্রামের হালিশহরে আইয়ুব নিবাস নামে করা একটি ছয়তলা ভবনের তথ্য তিনি গোপন করেছেন। এছাড়া আয়ের উৎস হিসেবে মাছের ফার্মের কথা তিনি সম্পদ বিবরণীতে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে সেটা সরকারি খাসজমি। এমন নানা অনিয়মে তার বিরুদ্ধে আরো একটি মামলায় চার্জশিটও হয়েছে। এর পরও তিনি কীভাবে দায়িত্ব পালন করছেন সেটা বোধগম্য নয়।

অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে জানতে এসএমএ আজিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কল রিসিভ করেনি।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অবৈধ সম্পদ অর্জনের ঘটনায় যার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে—এ ধরনের কর্মকর্তাকে দায়িত্বে রাখার সুযোগ নেই। বরং তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে তদন্ত কার্যক্রমকে বাধাহীন করতে হবে। পিডিবির এমনিতেই অনেক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এ ধরনের ঘটনার মধ্য দিয়ে সেসব অভিযোগ আরো বদ্ধমূল হয়ে উঠবে। অন্য কর্মকর্তারাও দুর্নীতিতে উৎসাহিত হবেন। তাদের মধ্যে ধারণা তৈরি হবে—এ ধরনের অপরাধ করেও দায়িত্বে থাকা যায়।

অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া আজিম বর্তমানে পূর্তকর্ম বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন। পিডিবির বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ এবং তার দেখভালের দায়িত্ব পালন করে থাকে এ পূর্তকর্ম বিভাগ। তার দায়িত্ব পালনের বিষয়ে জানতে কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি পিডিবির চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুর রহমানকে।

সূত্র—বিবি/এসএস/ফোরকান

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ


You cannot copy content of this page