তিন বছরে ২৫৮ কোটি টাকা হরিলুট–রাঘব বোয়ালরা অধরা!


মোহাম্মদ ফোরকান  ১৪ মে, ২০২৩ ১:০৯ : পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (চবক) ২৬টি গুরুতর আর্থিক অনিয়ম চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মোট পরিমাণ ২৫৮ কোটি ৫১ হাজার ৮৫৫ টাকা। চবকের ১৭ বিভাগের মধ্যে সবকটিতে অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে। কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) পরিবহন অডিট অধিদপ্তরের সর্বশেষ কমপ্লায়েন্স অডিট রিপোর্টে এসব অনিয়মের তথ্য উঠে আসে।

নিরীক্ষাকালে পরিবহন অডিট অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা অনিয়মের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগের বক্তব্য চেয়ে একাধিকবার ‘জিজ্ঞাসাপত্র’ ইস্যু করেন। জবাব দিতে আইনি বাধ্যবাধকতা থাকলেও ২৬টি গুরুতর আর্থিক অনিয়মের মধ্যে প্রায় ১৫টির কোনো জবাব দেননি সংশ্লিষ্টরা। এর মাধ্যমে অভিযোগের ‘সত্যতা’ মিলেছে বলে মনে করেন অডিট কর্মকর্তারা।

চবকের অডিট রিপোর্টটি নিয়ে সংসদের সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সাম্প্রতিক বৈঠকে আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কমিটির সদস্য ওয়াসিকা আয়েশা খান। বৈঠকে সংসদীয় কমিটি রিপোর্টে উল্লেখ ২৫৮ কোটি ৫১ হাজার ৮৫৫ টাকার অডিট আপত্তির বিষয়টি দ্রুত নিষ্পত্তির সুপারিশ করেছে বলে জানা গেছে।

নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং চট্টগ্রামের বন্দর-পতেঙ্গা আসনের সংসদ সদস্য এম এ লতিফ বলেন, এখনো অডিট রিপোর্টটি আমাদের কাছে উত্থাপিত হয়নি। বৈঠকে এজেন্ডাভুক্ত হলে আলোচনা শেষে লিখিত মতামত ও সুপারিশ দেবে সংসদীয় কমিটি।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, এটা একটা স্যাটেল ইস্যু, সিএজি তাদের রিপোর্ট প্রত্যাহার করে নিয়েছে, হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি থেকে এই ইস্যুটা বাদ দেওয়া হয়েছে। এই বিষয়ে আগে যারা রিপোর্ট করেছে তাদের প্রতিবাদ দেওয়া হয়েছে। তবে এই বিষয়ে অফিসিয়াল ডকুমেন্টস চাইলে তিনি দিতে পারেনি।

তবে– সিএজি সূত্রে জানা যায়, অনিয়ম-দুর্নীতির এই বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এই বিষয়ে গোপনে দফায় দফায় বৈঠকও করা হয়েছে। এবং রিপোর্টটি প্রত্যাহার করে নিতে সিএজিকে বার বার চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে।

সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক)-টিআইবি, চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি আখতার কবির চৌধুরী বলেন, ‘দেশে এখন সুশাসনের অভাব। জবাবদিহিতার অভাব। যার যা খুশি, তা-ই করা হচ্ছে। অডিট রিপোর্টও যেন গতানুগতিক রুটিনওয়ার্ক! কোনো অ্যাকশন নেই।

টাগবোট সরবরাহে ব্যর্থ ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ

চট্টগ্রামের নিউ ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপ বিল্ডার্স লিমিটেডের সঙ্গে টাগবোট সরবরাহের চুক্তি করেছিল চবক। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে এটি সরবরাহ করতে পারেনি ঠিকাদার। নিয়মানুযায়ী চুক্তি বাতিল, পারফরম্যান্স সিকিউরিটি বাজেয়াপ্ত, কালো তালিকাভুক্ত করাসহ ঠিকাদারের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা, কিন্তু তা না করে উল্টো চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও ব্যর্থ ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ করা হয়েছে। ওই বিলের পরিমাণ ২৩ কোটি ৮ লাখ ৮৩ হাজার ৩৪৩ টাকা।

জাহাজ ডকিং ও মেরামত কাজে নয়ছয়

চুক্তি সম্পাদনের মাত্র তিন দিনের মধ্যেই চবকের এমটি কাণ্ডারী-১ জাহাজের ডকিং ও মেরামত কাজ শেষ করে ফেলেছে ঠিকাদার! একই তারিখে চুক্তি সম্পন্ন হয়, আবার কার্যাদেশও দেওয়া হয়। কিন্তু কাজ শেষ করতে বেঁধে দেওয়া হয়নি কোনো সময়। এই সুযোগে মাত্র তিন দিনের মধ্যে কাজ শেষ হয়েছে দেখিয়ে ১২ কোটি ৬৭ লাখ ৬১ হাজার ৬০৭ টাকার চূড়ান্ত বিল দাখিল করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চিটাগং ড্রাই ডক লিমিটেড।

এদিকে মাত্র ১৩ দিনের মাথায় বিল পাস করে দেয় চবকের মেরিন প্রকৌশল বিভাগ। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাত্র তিন দিনে বড় অঙ্কের ওই টাকার কাজ সম্পন্ন করেছে, যা বাস্তবসম্মত নয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট কাজে অভিজ্ঞরা। অন্যদিকে মেরামত কাজে ত্রুটি দেখা দেওয়ায় জাহাজটির ভারপ্রাপ্ত নাবিক মো. রহিম খান মাত্র ২১ দিন পর ফের মেরামতের জন্য আবেদন করেন। জাহাজটি আসলে মেরামত করা হয়নি। চুক্তির তিন দিনের মধ্যে মেরামত দেখিয়ে টাকা নয়ছয় হয়েছে।

চারগুণ বেশি দামে স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী কেনা

করোনাকালে চবকের হাইড্রোগ্রাফি বিভাগ বাজারমূল্যের চেয়ে চারগুণ বেশি দামে কিনেছে স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী। এতে ৫৫ লাখ ৭৭ হাজার ৫০০ টাকার অনিয়ম হয়েছে। এসব সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে, এন-৯৫ সেফটি মাস্ক, সার্জিক্যাল হ্যান্ড গ্লাভস, অ্যাপ্রোন, প্রটেকটিভ গগলস, ডাক্তারদের ব্যবহারের জন্য পিপিই ইত্যাদি।

এ জন্য মেসার্স জনতা এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে দুই দফায় ৮৭ লাখ ৭০ হাজার টাকার বিল পরিশোধ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে কোটেশনও নেওয়া হয়নি। নিয়ম লঙ্ঘন করেই যন্ত্রাংশ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী সরবরাহের জন্য মনোনীত করা হয়।

বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চিকিৎসাসেবার জন্য হাসপাতাল ও আলাদা চিকিৎসা বিভাগ এবং মালপত্র সরবরাহের জন্য কেন্দ্রীয় ভান্ডার বিভাগ রয়েছে। এরপরও হাইড্রোগ্রাফি বিভাগ কৌশলে পছন্দের ঠিকাদারের মাধ্যমে অস্বাভাবিক বাড়তি দরে কিনেছে এসব স্বাস্থ্যসামগ্রী। এ ছাড়া কোনো চাহিদাপত্র ছিল না। কোন কোন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীর অনুকূলে এগুলো ইস্যু করা হয়েছে এর কোনো প্রমাণপত্র নেই।

দরপত্রের অধিকাংশ একই হাতে পূরণ করা

বন্দর কর্তৃপক্ষের ভান্ডার বিভাগ সমঝোতার ভিত্তিতে সীমিত দরপত্র পদ্ধতিতে ঠিকাদার নির্বাচন করেছে। এতে ১ কোটি ২০ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৯ টাকার অনিয়ম হয়েছে। চবক হাসপাতালের নবনির্মিত ভবনের জন্য পঞ্চম পর্যায়ে ৯ ধরনের আসবাবপত্র কেনার জন্য এই সীমিত দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্র আহ্বানের তারিখ : ২৬.১২.২০১৯।

অথচ দরপত্রে অংশ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর পে-অর্ডার আগের তারিখে ইস্যু করা। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আগেই বিজ্ঞপ্তিতে উল্লিখিত জামানতের টাকার পে-অর্ডার করা হয়েছে। কাজ পাওয়া ভাগ্যবান প্রতিষ্ঠানটি হলো ‘মেসার্স প্রভা এন্টারপ্রাইজ’।

সীমিত দরপত্র পদ্ধতিতে ১৬টি চুক্তিপত্র ও আনুষঙ্গিক নথিপত্র যাচাইয়ে দেখা যায়, দরপত্র সিডিউলগুলোর অধিকাংশ একই হাতে পূরণ করা হয়েছে। দরপত্রে অংশ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো একই তারিখের পে-অর্ডার এবং পাশাপাশি ক্রমিকের পে-অর্ডার দিয়েছে। প্রায় প্রতিটি দরপত্রে সমসংখ্যক চারটি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে।

নাভানা, অটবি, আক্তার ও হাতিল ব্র্যান্ডের আসবাব কেনার জন্য সীমিত দরপত্র পদ্ধতি প্রয়োগ করা হলেও এসব প্রতিষ্ঠান থেকে কিছুই কেনা হয়নি। নির্দিষ্ট ঠিকাদারকে কার্যাদেশ দেওয়ার বিষয়টি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আগেই নির্ধারণ করা হয়েছে বলে প্রমাণ মিলেছে।

প্রশিক্ষণের নামে টাকা আত্মসাৎ

চবকের ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনার নামে বড় অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত কিছু প্রশিক্ষণার্থীর ট্রেনিং ভাতা ও প্রশিক্ষকদের সম্মানী ভাতা বাবদ চবক বরাদ্দ দেয় ২৮ লাখ ৮০ হাজার ২০৮ টাকা। কিন্তু পুরো টাকা ব্যক্তিগত নামে পে-অর্ডারের মাধ্যমে উত্তোলন করেছেন ইনস্টিটিউটের ম্যানেজার (ট্রেনিং) হালিমা বেগম ও সিনিয়র ট্রেনিং অফিসার মো. আবদুল হান্নান।

প্রশিক্ষণার্থী বা প্রশিক্ষক কাউকে কোনো টাকা প্রদান বা গ্রহণের কোনো প্রমাণপত্র নেই সংশ্লিষ্ট দপ্তরে। ইনস্টিটিউটের নথি, বিল ভাউচার এবং অন্যান্য রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় এসব টাকা আত্মসাতের প্রমাণ মিলেছে। আর প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও ভুয়া বলে প্রতীয়মান হয়েছে।

আরও যত অনিয়ম

চবকের ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল—এই তিন অর্থবছরের আয়-ব্যয়ের আর্থিক কার্যক্রমের নথি পর্যালোচনায় পাওয়া অনিয়মের মধ্যে আরও রয়েছে..

১–অস্বাভাবিক দরে ঠিকাদারের মাধ্যমে সিসিব্লক ও আরসিসি প্রিকাস্ট পাইল পরিবহন কাজ সম্পাদন।

২–ঠিকাদারের প্রস্তাবিত দর অপেক্ষা অধিক দরে চুক্তি সম্পাদন

৩– বিদেশ ভ্রমণে প্রাপ্যতার অতিরিক্ত হোটেলভাড়া ও নগদ ভাতা গ্রহণ

৪–চুক্তি করা কাজের পরিমাণ অপেক্ষা অধিক কাজের বিল পরিশোধ।

৫–বিদেশে ভ্রমণভাতা বিলে অস্বাভাবিক হারে বিমানভাড়া গ্রহণ।

৬–লিজ গ্রহীতার কাছ থেকে বন্দরের ভূমি ব্যবহারজনিত নির্ধারিত ভাড়া অপেক্ষা কম হারে আদায়। বিধি বহির্ভূতভাবে ভূমি অধিগ্রহণের জন্য ২ শতাংশ প্রশাসনিক খরচ প্রদান।

৭– বার্থ ও টার্মিনাল অপারেটরের কাছ থেকে স্পেস রেন্ট বাবদ অর্থ আদায় না করা।

৮– নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার পরও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোটি কোটি টাকা ইনসেনটিভ বোনাস পরিশোধ ইত্যাদি।

সূত্র—কেবি/এসএস

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ


You cannot copy content of this page