চট্টগ্রামে অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ভবন-কারখানার ছড়াছড়ি


নিজস্ব প্রতিবেদক ৫ মার্চ, ২০২৪ ২:৩৬ : অপরাহ্ণ

৬০ লাখ মানুষের আবাস্থল ও কর্মস্থল বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। বর্তমানে এই নগরে বহুতল ভবনের সংখ্যা ১৩ হাজারের বেশি। পাশাপাশি চট্টগ্রামের ১৭টি শিল্পাঞ্চলের ছোট এবং মাঝারি কারখানার সংখ্যা এক হাজার ২৫০টি। তবে বিস্ময়কর হলো এসব বহুতল ভবন ও কারখানা যাদের অনুমতি নিয়ে গড়ে উঠেছে, সেই চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ও ফায়ার সার্ভিসের কাছে এর কতটি অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ সেই তালিকা নেই।

বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনার পরে ঘটা করে তালিকা তৈরির কথা বলা হলেও তা আর আলোর মুখ দেখেনি। সর্বশেষ চট্টগ্রামের এস আলম সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের মিলে সোমবার (৪ মার্চ) বিকেলে লাগা আগুন সাড়ে ১৭ ঘণ্টা (মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টা পর্যন্ত) পরও পুরোপুরি নির্বাপণ সম্ভব হয়নি।

চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের নথি অনুযায়ী, ২০২১-২০২৩ এই তিন বছরে চট্টগ্রামে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে পাঁচ হাজার ৯০৯টি। এসব ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩৪৭ জন। এর মধ্যে ২০২১ সালে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে এক হাজার ৯১০টি। এসব ঘটনায় ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ২০ কোটি ৬৮ লাখ টাকা, নিহত হন ৬০ জন।

এক বছর পর ২০২২ সালে প্রায় সমান সংখ্যক বা এক হাজার ৯১১টি অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৪৩ কোটি ৫৮ লাখ টাকায়। অগ্নিকাণ্ডে নিহতের সংখ্যাও বেড়ে দাঁড়ায় ২৫৯ জনে। ২০২৩ সালে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে দুই হাজার ৮৮টিতে। এসব ঘটনায় ২৮ জনের প্রাণহাণি ঘটে; ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩৯ কোটি ২৬ লাখ টাকা।

নগর পরিকল্পবিদরা বলছেন, অপরিকল্পিত অবকাঠামো উন্নয়ণ ও সমন্বয়হীনতার কারণে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম মৃতুকূপে পরিণত হচ্ছে। এ অবস্থায় ব্যাপক আকারে সমীক্ষা চালিয়ে অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ বহুতল ভবন ও কারখানাগুলো শনাক্ত করা না গেলে বিপর্যয় ঠেকানো যাবে না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সহকারী পরিচালক আবদুল মালেক বলেন, নগরীর মোট কতটি ভবন অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ সেই পূর্ণাঙ্গ তালিকা আমাদের নেই। তবে ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের পরিদর্শনকারী দল চট্টগ্রামের দুই হাজার ১৪৬টি বহুতল ভবন পরিদর্শন করে। এর মধ্যে ৩৯৮টি ভবনকে অতিঝুঁকিপূর্ণ ও ৫২৬টি বহুতল ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে নিরাপত্তা মানের উন্নীত করতে সময় বেঁধে দিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস।

ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা বলেন, বহুতল ভবন ছাড়াও চট্টগ্রাম নগরীতে ভবনের সংখ্যা প্রায় চার লাখ। অতিঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা ঢাকার চেয়ে চট্টগ্রামে বেশি। তিনি বলেন, ২০১৬ সাল থেকে প্রতি বছরই নিয়ম করে ঢাকার বহুতল ভবনগুলো পরিদর্শন করে আসছে ফায়ার সার্ভিস। যেসব বহুতল ভবনে নিরাপত্তা ত্রুটি ছিল, সেগুলো শনাক্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছিল। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো ছয় মাস অন্তর পরিদর্শন করা হয়েছে। এতে ভবন মালিকরাও বাধ্য হয়েছেন নিরাপত্তা নির্দেশিকা বাস্তবায়নে। কিন্তু ২০২১ সালের আগে চট্টগ্রামের বহুতল ভবনগুলোর নিরাপত্তাব্যবস্থা পরিদর্শন করা হয়নি।

আবদুল মালেক আরও বলেন, বিএম ডিপো বিস্ফোরণের পর ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রামে বিদ্যমান ১৫টি অক্সিজেন প্ল্যান্টের মধ্যে ১৩টিকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে। এছাড়া ২৪টি কনটেইনার ডিপোর (অফডক) ২১টিই ফায়ার সেফটি প্ল্যান বাস্তবায়ন করেনি বলে রিপোর্ট দেয়। তবে এর বাইরে থাকা কারখানাগুলোতে একইভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়নি।

এদিকে চট্টগ্রাম নগরে কতটি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাছেও। সম্প্রতি সংস্থাটি জানায়, চট্টগ্রাম নগরে ৬ থেকে ১০ তলা পর্যন্ত ভবন রয়েছে ১৩ হাজার ১৩৫টি। ১০ তলার ওপরে ভবন রয়েছে ৫২৭টি। এসবের মধ্যে কী পরিমাণ ভবন অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে, তার কোনো পূর্ণাঙ্গ তালিকা কোনো সংস্থার কাছে নেই। অথচ ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে তা অপসরাণের ব্যবস্থা করার কথা রয়েছে সংস্থাটির।

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী ঈসা আনসারী বলেন, অগ্নিদুর্ঘটনা বা ভূমিকম্পে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন কতটি, তা নিয়ে আমাদের রিসেন্ট কোনো কাজ নেই। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) একবার করেছিল। আগামীতে সিডিএ’র যে মাস্টারপ্ল্যান হবে সেখানে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকাটা করা হবে।

১৩ বছর আগে ২০১১ সালে চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরি তালিকায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের মধ্যে আবাসিক ভবন ৩৫টি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একটি, আবাসিক ও বাণিজ্যিক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এমন ভবন ১২টি এবং শুধু বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে এমন ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে ৯টি।

তবে সিডিএ’র তালিকার চেয়ে চট্টগ্রাম নগরে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা অনেক বেশি বলে মনে করেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এবং রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) বর্তমান উপাচার্য প্রফেসর ড. ইঞ্জিনিয়ার মো. জাহাঙ্গীর আলম।

তিনি বলেন, ২০১১ সালের পর চট্টগ্রামে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা নিরূপণে কোনো সমীক্ষা হয়নি। নগরীর বেশিরভাগ ভবনই ঝুঁকিপূর্ণ। বহুতল ভবনগুলো স্ট্রাকচারাল ডিজাইন মেনে করা হয়েছে কি না তা প্রকৃতপক্ষে দেখার কেউ নেই। এমনকি বিষয়টি দেখভালের দায়িত্বে থাকা সিডিএ’র স্ট্রাকচারাল ডিজাইন পরীক্ষার কোনো সেল বা বিভাগ নেই। ফলে ভবনের নকশায় কমবেশি দুর্বলতা থাকার আশঙ্কা থেকে যায়।

তিনি বলেন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক যেসব ভবন ও স্থাপনার নকশা দেওয়া হয় তার মধ্যেও নির্মাণের সময় অধিকাংশই কমবেশি পরিবর্তন করা হয়ে থাকে। এর ফলেও ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। যার কারণে অগ্নিকাণ্ডসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভবনগুলো বসবাসকারীদের জন্য মৃত্যুকূপে রূপ নেবে।

এদিকে ব্যস্ততম নগরী ঢাকায়ও আগুনে মৃত্যুর মিছিল যেন থামছে না, বরং দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে লাশের সারি। একের পর এক ঘটছে অগ্নিকাণ্ড। একটির ক্ষত শুকানোর আগেই আরেকটি অগ্নিদুর্ঘটনা, বাড়ছে মৃত্যু।

সর্বশেষ গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ নামের ভবনে আগুনে ৪৬ জন মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। এরপর নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। সোমবার (৪ মার্চ) বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। এতে রেস্টুরেন্টে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র না থাকা, ফুটপাতে গ্যাসের সিলিন্ডার ও রান্নার চুলা রাখাসহ নানা অভিযোগে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেফতার ৪৪৪ জনকে জরিমানাও করেছেন আদালত।

এসএস/এমএফ

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ