কেনাকাটায় মিলেমিশে লুটপাট করেন তারা!


নিজস্ব প্রতিবেদক ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ১১:৫৩ : অপরাহ্ণ

সরকারি সব সেক্টরেই নিয়োগ, বদলি, কেনাকাটা, পোস্টিংসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঘুষ-দুর্নীতি, লুটপাট এখন খোলামেলা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যক্তি পর্যায়ের লুটপাট ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি চরম আকার ধারণ করেছে। অতিলোভী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অব্যাহত লুটপাটে সরকারি একেকটি প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে দুর্নীতির আখড়া।

সম্প্রতি ১৫ হাজার টাকা দামের প্রতিপিস জানালার পর্দা (জেব্রা ব্লাইন্ড) কেনা হয়েছে ৪১ হাজার ৬৬৬ টাকায়। ৮৫০ টাকা মূল্যের প্রতিটি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র (ফায়ার এক্সটিংগুইসার) কেনা হয়েছে সাড়ে ৫ হাজার টাকায়। এছাড়া প্রশিক্ষণার্থীদের ছবি তোলার বুথ বসাতে খরচ ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৭৫ টাকা। পরিচ্ছন্নতাকর্মী থাকার পরও প্রতিষ্ঠানের মোজাইক পরিস্কারের জন্য ধরা হয়েছে আলাদা বরাদ্দ।

এমন লুকোচুরি কেনাকাটা চলছে চট্টগ্রাম মহানগরের আসকারদীঘির পাড়ে অবস্থিত চট্টগ্রাম আঞ্চলিক লোক-প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে (আরপিএটিসি)। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনায় ১ কোটি ৮৬ লাখ ৩৫ হাজার টাকার বরাদ্দ নয়ছয় হয়েছে এভাবে। ক্রয় পরিকল্পনায় দেখা গেছে, গ্রিল রং করার জন্য ৪ লাখ টাকা, অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য ৩ লাখ টাকা, সৌন্দর্যবর্ধনে গাছ সরবরাহের জন্য ২ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।

ক্রয় পরিকল্পনার ৩৮টি আইটেমের মধ্যে ৩৬ নম্বরে আছে অডিটোরিয়াম ও কম্পিউটার ল্যাবের জানালার পর্দা (জেব্রা ব্লাইন্ড)। এজন্য বরাদ্দ হয়েছে ৫ লাখ টাকা। এটির দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। এখানে ১৫ হাজার টাকা দামের প্রতিটি পর্দা কেনা হয়েছে ৪১ হাজার ৬৬৬ টাকায়।

লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রশাসনিক ভবনের ৩য় তলায় সুবিশাল অডিটোরিয়াম জুড়ে ১২টি পর্দা লাগানো হয়েছে। প্রতিটি পর্দা কেনা হয়েছে ৪১ হাজার ৬৬৬ টাকায়। এসব পর্দার প্রতিটির দৈর্ঘ্য ৭ ফুট ৮৪ ইঞ্চি এবং প্রস্থ ৮ ফুট ৯৬ ইঞ্চি। সেই হিসেবে মোট ৫৬ স্কয়ার ফুটের পর্দার প্রতি স্কয়ার ফুট ২৫০ টাকা করে ১৪ হাজার টাকার মধ্যে থাকবে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি মোড় এলাকার ডালাস ফার্নিশিং ফ্রেব্রিকসের সেলস এক্সিকিউটিভ মো. ইমরান।

এছাড়া ক্রয় পরিকল্পনা তালিকার ২২ নম্বরে আছে প্রশাসনিক ভবন ও প্রশিক্ষণ ভবনের নিচতলা থেকে ৩য় তলা পর্যন্ত লোহার গ্রিল রং করার কাজ। এটির জন্য বরাদ্দ আছে ৪ লাখ টাকা এবং এটিতে ব্যয় দেখানো হয়েছে ৪ লাখ টাকাই। কিন্তু সরেজমিন কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে গ্রিলে রংয়ে মরিচা ধরেছে। অনেক জায়গায় মরিচার ওপর রংয়ের প্রলেপ দেওয়া হলেও তা উঠে গেছে।

কম্পিউটার ও আনুষাঙ্গিক যন্ত্রপাতি ক্রয়ে বরাদ্দ হয়েছে ১৫ লাখ টাকা। সিসি ক্যামেরা ও পিবিএক্স লাইন সম্প্রসারণের জন্য ৬ লাখ, ইন্টারনেট লাইন সম্প্রসারণের জন্য ২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেখানো হয়েছে। ক্রয় পরিকল্পনার ২৮ নম্বর পণ্য তালিকায় রয়েছে মোজাইক পরিস্কার করার কাজ। প্রশাসনিক ভবনের নিচতলা থেকে ৩য় তলা পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানের মোজাইক পরিস্কার কাজে বরাদ্দের ২ লাখ টাকার পুরোটাই ব্যয় দেখানো হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, কেন্দ্রের পরিচ্ছন্নতাকর্মী রাখাল চন্দ্র দাশ মোজাইক পরিস্কারের কাজ করছেন।

অপরদিকে হেল্পডেস্ক স্থাপনে বরাদ্দ দেখানো হয়েছে ৫ লাখ টাকা, কম্পিউটারে উইন্ডোজ ও অফিস প্রোগ্রাম ইনস্টলের জন্য ৫০ হাজার টাকা এবং প্রশিক্ষণ ব্যাগের জন্য বরাদ্দ দেখানো হয়েছে ৮ লাখ টাকা। এছাড়া প্রশিক্ষণার্থীদের ছবি তোলার জন্য ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকায় ফটোবুথ স্থাপন ব্যয় দেখানো হয়েছে।

ক্রয় পরিকল্পনায় তালিকার ১৭ নম্বরে থাকা আধুনিক অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতি ক্রয় করার জন্য বরাদ্দ রয়েছে ৩ লাখ টাকা। ৯১টি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র কেনার জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্র পাওয়া প্রতিষ্ঠান প্রতি পিস অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা দামে দিয়েছে। অথচ এগুলোর প্রতিটির বাজার মূল্য ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকার মধ্যে।

নগরীর জুবিলী রোডের অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স মোতাহের অ্যান্ড সন্সের মালিক মোতাহের বলেন, আমরা সরকারি অফিসে যেসব অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র সরবরাহ করি, তা ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকার মধ্যেই থাকে।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক লোক প্রশাসন কেন্দ্রের হিসাবরক্ষক ইকরামুল আহসান বলেন, ৯১টি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র কেনার দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। প্রতি পিসের দাম পড়েছে পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। বেশি দাম হলেও আমরা ভালো পণ্যটাই নিতে চেয়েছি।

জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির উপ-পরিচালক মনোয়ারা বেগম বলেন, প্রতিবছর কেন্দ্র থেকে প্রায় ৩০টি সেশনে পর্যাপ্ত সংখ্যক প্রশিক্ষণার্থী প্রশিক্ষণে অংশ নেন। প্রশিক্ষণ শেষ দিবসে সনদ বিতরণী অনুষ্ঠানে সবাই দলবেঁধে কিংবা সিঙ্গেল ছবি তুলতে চায়। এত বছর সবাই কেন্দ্রে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছবি তুলেছে। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর ফটোবুথ করার আইডিয়াটা মাথায় আসে। আর আমি সেটি ক্রয় পরিকল্পনায় সংযুক্ত করেছি।

ফটোবুথের জন্য ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা বরাদ্দ সরকারি অর্থের অপচয় কিনা? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রশিক্ষণার্থীদের শখ পূরণের জন্য কিছুটা তো অপচয় হতেই পারে। ক্রয় পরিকল্পনার সঙ্গে বাস্তব বাজারদরের পার্থক্য প্রসঙ্গে উপপরিচালক মনোয়ারা বেগম আরও বলেন, সবসময় তো বাজারদরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ক্রয় পরিকল্পনা করা হয় না। আমাদেরও কিছু স্ট্রাটেজি থাকে। সেভাবেই ক্রয় পরিকল্পনা কমিটি গঠন করা হয়, কাজও সম্পাদন করা হয়।

চট্টগ্রাম আঞ্চলিক লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের তথ্য ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা নূর-এ-জান্নাত রুমি বলেন, বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা থেকে মূল ব্যয় খুব বেশি ডিফারেন্ট হতে পারে না। ক্রয় পরিকল্পনার বরাদ্দকৃত আইটেম বেশিরভাগেরই দরপত্র হয়েছে। ওয়ার্ক অর্ডারও সাবমিট হয়েছে। আবার কিছু আইটেম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

সূত্র—ডিঈ/এসএস

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ