৩৪টি খালের ১২টি খাল অস্তিত্বহীন..

কি করছে কর্তৃপক্ষ! ৪৮ বছরের মাস্টারপ্ল্যান এখনো ঝুলে আছে


মোহাম্মদ ফোরকান ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ৩:৪২ : পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামকে পরিকল্পিত নগর হিসেবে গড়তে ৪৮ বছর আগে প্রণয়ন করা হয়েছিল মাস্টারপ্ল্যান। ১৯৬৯ সালে সেই মাস্টারপ্ল্যানে নগরের ৩৪টি খাল চিহ্নিত করা হয়েছিল। কিন্তু ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম ওয়াসা প্রণীত ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যানে খাল পাওয়া গেছে মাত্র ২২টি। ৪৮ বছরের ব্যবধানে নগরের মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে ১২টি খাল। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নির্বিচারে দখল ও রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ার তিন কারণে এসব খাল হারিয়ে গেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিলীন হওয়ার পথে বিদ্যমান খালগুলো। নতুন ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী, এসব খালও পানিপ্রবাহের ক্ষমতা হারিয়েছে ৪২ শতাংশ। এ কারণে এখন সামান্য বৃষ্টিতেই কোমরপানিতে তলিয়ে যায় বন্দরনগরী চট্টগ্রাম।

পাকিস্তান শাসনামলে চট্টগ্রাম নগরকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে তৈরি করা হয় মাস্টারপ্ল্যান। এ জন্য ১৯৬৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান ভিত্তিক প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান জন আর স্নেল তৈরি করে ‘স্টর্ম ড্রেনেজ অ্যান্ড ফ্ল্যাড কন্ট্রোল, মাস্টার প্ল্যান অ্যান্ড ফিজিবিলিটি রিপোর্ট ফর চিটাগং। এ ফিজিবিলিটি স্টাডিতে চট্টগ্রাম শহরের কালুরঘাট থেকে নেভাল একাডেমি ৩৪টি খালের মুখ চিহ্নিত করা হয়েছিল। তখন খালগুলো নগরের বিভিন্ন এলাকায় প্রবাহিত হয়ে কর্ণফুলী নদীর সাথে যুক্ত ছিল।

এরপর ১৯৭২ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড, ১৯৮৬ সালে লুইস বার্জার, ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম ওয়াসা মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করে। এর মধ্যে ১৯৬৯, ১৯৯৫ ও ২০১৭ সালের মাস্টারপ্ল্যানে ছিল নগরের ড্রেনেজ ব্যবস্থার সুক্ষ পরিকল্পনা।

সর্বশেষ ২০১৭ সালে চিটাগাং ওয়াটার সাপ্লাই ইমপ্রুভমেন্ট অ্যান্ড স্যানিটেশন প্রকল্পের আওতায় ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করে চট্টগ্রাম ওয়াসা। বাংলাদেশ প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান অ্যাকোয়া কনসালট্যান্ট অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েট অ্যান্ড ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউওএম)-এর সহায়তায় এবং ডেনমার্কের প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান গ্রন্টমি দীর্ঘ দুই বছর সমীক্ষা শেষে এ মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করে।

কিন্তু সে সমীক্ষায় মাত্র ২২টি খালের সন্ধান মিলেছে। ১২টি খালের কোনো অস্তিত্বই পায়নি প্রতিষ্ঠানটি। এসব খালের বেশিরভাগ হচ্ছে নগরের ফিরিঙ্গি বাজার, সৈয়দশাহ রোড, ফিশারিঘাট, অভয়মিত্রঘাট, সদরঘাট ও মাঝিরঘাট এলাকায়। আরএস জরিপে এসব খালের অস্তিত্ব থাকলেও বিএস জরিপে জালিয়াতির মাধ্যমে ভিটাবাড়ি দেখিয়ে খালগুলো দখল করে নিয়েছে ভুমিদস্যুরা।

প্রথমে খালের দু’পাড় দখল করে তারা। এরপর খালের উপর অস্থায়ী স্থাপনা গড়ে তুলে একপর্যায়ে সেই স্থাপনার স্থলে গড়ে তোলা হয় স্থায়ী বহুতল ভবন। প্রশাসনের কোনো নজরদারি না থাকায় রক্ষণাবেক্ষণও করা হয়নি খালগুলোতে।

জানতে চাইলে সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ বলেন, আবদুস সালামের আমলে যথাযথ সঠিক সিদান্ত না নিয়েই জলাবদ্ধতা নিরসনে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে পাঁচ হাজার ৬১৬ কোটি ৫০ লাখ টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়নে বরাদ্ধ দিয়েছিল সরকার। এ প্রকল্পের অধীনে মোট ৩৬টি খাল সংস্কারের কথা থাকলেও এখনও সবগুলো কালের কাজ শেষ করতে পারেনি সিডিএ। অথচ তাদের প্রকল্প শেষ হয়ে আরো এক বছর সময় বেশি হয়েছে।

জানা যায়, সাবেক সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুস সালামের আমলে প্রাথমিকভাবে মহেশখাল, খন্দকিয়া খাল, নাছির খাল, চাক্তাই খাল, বির্জা খাল, রাজাখালী খাল-১, রাজাখালী খাল-২, হিজড়া খাল, কলাবাগিচা খাল, ডোমখাল, বামুনশাহী খাল, বাকলিয়া খাল, নোয়া খাল, মির্জা খাল, মরিয়মবিবি খাল ও রাজাখালী খাল-৩ সংস্কারের কাজ করেছিলো। কিন্তু ৩৬টি খালের সবক’টি যথাযথভাবে সংস্কার না হওয়ায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে পারেনি তৎকালিন চেয়ারম্যান। খালপাড়ের পানি প্রবাহ স্বাভাবিক করতে না পারায় সামান্য বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় চট্টগ্রামের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা। জোয়ারের পানি ও বৃষ্টির পানি মিশ্রিত হয়ে ডুবে থাকে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা মন্দির ও হাসপাতাল।

সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের উদাসীনতাই চট্টগ্রাম শহরকে পরিকল্পনা অনুযায়ী এখনো সাজাতে পারেনি কেউও। আজ সে খেসারত হিসেবে হারিয়ে গেছে ১২টি খাল। এখন বৃষ্টি ও জোয়ারের পানির প্রবাহে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে পুরো চট্টগ্রাম শহর।

নগরের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাওয়া ১২টি খাল পুনরুদ্ধারের প্রয়োজনীয়তার কথা এখন কারো মুখে শুনা যায় না। কিন্তু মাস্টারপ্ল্যানে থাকা সুপারিশ ধরে কাজ করছে না কর্তৃপক্ষ। খাল দখল করে একর পর এক স্থাপনা গড়ে উঠছেই, কিন্তু কারো মাথা ব্যাথা নেই। নির্মাণ করা খালের উপর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে না পারায় সামান্য বৃষ্টিতেই ডুবে যাচ্ছে বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণ হতে হলে (আরএস) জরিপ অনুযায়ী হারিয়ে যাওয়া সেই ১২টি খাল পুনরুদ্ধার করতে হবে। দখল করা খাল নতুন করে খনন করতে হবে। নতুন মাস্টারপ্ল্যান ধরে দখলদারদের উচ্ছেদ করতে হবে। অতি জোয়ারের পানিতে ১৯ শতাংশ কালভার্টের ওপর দিয়েই এখন প্রবাহিত হয় খালের পানি। প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে মাথায় রাখতে হবে এসব বিষয়ও।

চট্টগ্রাম ওয়াসার ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান বলছে, ৪২ শতাংশ পানি প্রবাহের ক্ষমতা হারিয়েছে নগরের প্রধান খালগুলো। রাস্তার পাশে থাকা ড্রেনের মধ্যে ৩২ শতাংশ বন্ধ হয়ে গেছে এবং কার্যক্ষমতা হারিয়েছে। পানিপ্রবাহের কার্যকারিতা হারিয়েছে ১৯ শতাংশ কালভার্টও।

এখন এগুলোর ওপর দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে পানি। নগরীকে জলাবদ্ধতামুক্ত করতে হলে রাস্তার পাশের ৯০ শতাংশ বিদ্যমান ড্রেন সংস্কার ও ৫৫ শতাংশ অতিরিক্ত ড্রেন খনন করতে হবে জরুরিভিত্তিতে। তিনটি নতুন খাল ও ৩০টি নতুন সেকেন্ডারি খাল খননেরও সুপারিশ যতাযত বাস্তবায়ন সময়ের দাবী সংশ্লিষ্ট মহলের।

২০১৮ সালের ৯ এপ্রিল চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে গৃহীত মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে সিডিএর সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এরপর সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর খালের উভয় পাশে রিটেইনিং ওয়াল, রাস্তা নির্মাণ ও নিচু ব্রিজগুলো ভেঙে উঁচু করার কাজ শুরু করে। পাশাপাশি খাল থেকে ময়লা পরিষ্কার কার্যক্রমও শুরু হয়।

ডিপিপি অনুযায়ী গৃহীত এ মেগা প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৫ হাজার ৬১৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। তিন বছর মেয়াদি এ প্রকল্পে প্রাথমিক পর্যায়ে ২০১৮ সালে ৩৬ খালের মাটি অপসারণসহ ৩০০ কিলোমিটার নতুন ড্রেন নির্মাণ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়।

প্রকল্পের আওতায় নতুন করে ১০০ কিলোমিটার ড্রেন নির্মাণ, ২০২০ সালের মধ্যে নগরে ৩৬টি খাল খনন, খালের পাশে ১৭৬ কিলোমিটার প্রতিরোধক দেয়াল, ৮৫ কিলোমিটার সড়ক, ৪২টি সিল্ট ট্র্যাপ নানা অবকাঠামো নির্মাণ করার কথা রয়েছে।

প্রসঙ্গত চট্টগ্রামকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে এ পর্যন্ত মোট পাঁচটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হলেও কোনোটিই বাস্তবায়ন করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ