দীর্ঘ ২০ বছর ধরে আফগানিস্তানে কোটি কোটি ডলার খরচ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ সময়ে হাজার হাজার সৈন্যের দেহ কফিনবন্দিও হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের দীর্ঘতম যুদ্ধের ফলাফলটা শূন্য। খালি হাতেই আফগানিস্তান থেকে ফিরতে হলো তাদের।
পেন্টাগন থেকে এ পর্যন্ত যে পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে সে অনুযায়ী, গত ২০ বছরে আফগানিস্তানে যুদ্ধের পেছনে দুই লাখ ২৬ হাজার কোটি ডলার খরচ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে শুধুমাত্র আফগান সেনাদের প্রশিক্ষণ দিতেই খরচ হয়েছে আট হাজার ৯০০ কোটি ডলার। ২০২০ সালের একটি রিপোর্টে পেন্টাগন জানায়, সরাসরি যুদ্ধেই তাদের ৮১ হাজার ৫৭০ কোটি ডলার খরচ হয়েছে।
মূলত আল কায়েদা এবং তাদের আশ্রয়দাতা তালেবান নিধনের লক্ষ্যেই আফগানিস্তানে পা রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্র। আফগানিস্তানকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ঋণ পর্যন্ত নিতে হয় তাদের। সেই ঋণের সুদ বাবদই যুক্তরাষ্ট্রকে ৫৩ হাজার কোটি ডলার গুনতে হয়েছে বলে স্পেশাল ইনস্পেক্টর জেনারেল ফর আফগানিস্তান রিকনস্ট্রাকশন (সিগার)-এর একটি রিপোর্টে উঠে এসেছে।
২০০৯ সালে আফগানিস্তানে সেনা বাড়িয়ে এক লাখ করেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। আফগান সেনা এবং পুলিশ মিলিয়ে তালেবানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে লড়াইয়ে নামে ৩ লক্ষ সেনা।
সিগার-এর রিপোর্ট বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের দুই হাজার ৪৪২ জন সেনার মৃত্যু হয়েছে। বেসরকারি সংস্থা থেকে নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে আফগানিস্তানে গিয়ে প্রায় চার হাজার জন মারা গেছেন, তাদের অধিকাংশের মৃত্যুর কোনো রেকর্ডই নেই পেন্টাগনের কাছে। আবার গুরুতর জখম হয়ে ফিরেছেন ২০ হাজার ৬৬৬ জন।
সিগারের দাবি, সবমিলিয়ে আফগানিস্তান থেকে বেঁচে ফিরেছেন যেসব সৈনিক, তাদের চিকিৎসা এবং কল্যাণ ভাতা বাবদ ২৯ হাজার ৬০০ কোটি ডলার খরচ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। যত দিন তারা বেঁচে থাকবেন, তত দিন তাদের ভাতা দিতে হবে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে।
তবে যুক্তরাষ্ট্র জলের মতো টাকা খরচ করলেও গত ২০ বছরে আফগানিস্তানের পরিস্থিতির তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। বাঁধ, পাকা রাস্তা, স্কুল, হাসপাতাল তৈরি হয়েছে। কিন্তু ২০২০ সালে বিশ্ব ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, আফগানিস্তানে এখনও বেকারত্বের হার ২৫ শতাংশ এবং দারিদ্রের হার ৪৭ শতাংশ।
শুধুই কি আর্থিক ক্ষতি? দীর্ঘ এ যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা টাকার অংকে নির্ণয় করা সম্ভব নয় বলে মত কূটনীতিকদের একটি বড় অংশের। তাদের মতে, ভিয়েতনাম থেকে শিক্ষা নিয়ে আফগানিস্তান থেকে আগেই সরে যাওয়া উচিত ছিল যুক্তরাষ্ট্রের।
শান্তি এবং স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে আনার আশ্বাস দিয়ে এক সময় আফগানিস্তানে ঘাঁটি গেড়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু আফগানবাসীকে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে পাততাড়ি গুটিয়ে নেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে মঙ্গলজনক নয় বলে মনে করছেন কূটনীতিকরা।
তাদের মতে, ইতিহাস সাক্ষী গৃহযুদ্ধ বাঁধলেই আফগানিস্তানে বিদেশি শক্তির আগমন ঘটে। যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ছেড়ে পুরোপুরি চলে গেলে তার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। দু’দশক আগে যুক্তরাষ্ট্রের নেওয়া একতরফা সিদ্ধান্তে এ পর্যন্ত আফগানিস্তানেরই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। ৯/১১ হামলায় যদি তিন হাজার নিরীহ মানুষের প্রাণহানি হয়ে থাকে, গত ২০ বছরে আফগানিস্তানে প্রাণ হারিয়েছেন ৪৭ হাজার ২৪৫ জন নাগরিক।
তালেবান, মুজাহিদিন বা অন্য কোনো জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে কোনো সংযোগ ছিল না তাদের। আফগানিস্তান নিয়ে সংবাদ প্রচার করতে ৮০ জন সাংবাদিক প্রাণ হারিয়েছেন। আবার যুদ্ধক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করতে গিয়ে চার শতাধিক মানুষ মারা গেছেন। এসব তথ্য দিয়েছে যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে করা যুক্তরাষ্ট্রেরই ব্রাউন ইউনিভার্সিটির একটি রিপোর্ট।
যুদ্ধে নেমে কত জন সেনা মারা গেছেন এ পর্যন্ত তার সঠিক হিসাব যদিও খোলসা করেনি আফগানিস্তান সরকার। সেনার মনোবল ভেঙে যাবে বলেই তা গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানায় আফগান সরকার। তবে গত ২০ বছরে প্রায় ৭০ হাজার আফগান সেনা মারা গেছেন বলে অনুমান বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের।
কিন্তু এত কিছুর পরও ‘সর্বশক্তিমান যুক্তরাষ্ট্র’ তালেবানকে কেন রুখতে পারল না? এ বিষয়ে নানা ব্যাখ্যা উঠে আসছে। কূটনীতিকদের একাংশের মতে, আফগানিস্তানে আসলে অহংকারের লড়াই লড়তে গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তালেবানের কাছে তা ছিল শিকড় রক্ষার লড়াই। তাই যত বার আঘাত নেমে এসেছে, ভূপতিত হয়েও বারবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে তারা। গুলি-বোমায় একজন তালেবান মারা গেলে তার জায়গায় আরও ১০ জন এগিয়ে এসেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমস-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে লাঘমান প্রদেশে তালেবানের সামরিক শাখার প্রধান মৌলভি মোহাম্মদ কায়েস বলেন, এ লড়াইটা আমাদের কাছে আল্লাহর কাছে আরাধনার মতো। তাই এক ভাই মারা গেলে, দ্বিতীয় জন ওপরওয়ালাকে অসন্তুষ্ট করবে না। বরং সর্বশক্তি দিয়ে আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
২০১৩ সাল থেকে আফগানিস্তানে প্রায় ২৭ হাজার বোমা নিক্ষেপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে গতবছরই সাত হাজার ৪০০ বোমা নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু মার্চ মাসে যুক্তরাষ্ট্র সেনা সরানোর কথা ঘোষণা করার পর থেকে সেখানে তালেবান এবং যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের মুখোমুখি সংঘর্ষ প্রায় বন্ধ। বরং আফগান সেনাকেই বেছে বেছে নিশানা করেছে তালেবান। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনের অনুমান, বর্তমানে আফগানিস্তানে সক্রিয় তালেবান যোদ্ধার সংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার।
এছাড়া মধ্যস্থতাকারী হিসেবে এবং আংশিক যোদ্ধা হিসেবে বহু সদস্য তাদের হয়ে লড়াই করছেন, সরাসরি যারা তালেবানের সঙ্গে নাম জড়াতে রাজি নন। আফগান সেনা থেকেও অনেকে তালেবানে যোগ দিয়েছেন। আবার হানাহানি এড়াতে তাদের সঙ্গে সমঝোতার পথ বেছে নিয়েছেন বিভিন্ন প্রদেশের গভর্নররা। তাতেই আশরাফ গনি, যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো-কে হটিয়ে ২০ বছর পর ফের তালেবান কাবুলে শাসন কায়েমের পথে বলে মনে করছেন কূটনীতিকরা।
সূত্র: আনন্দবাজার