২২ কোটি টাকার বিনামূল্যে জিন থেরাপি পেলো শিশু রায়হান


নিজস্ব প্রতিবেদক ২৬ অক্টোবর, ২০২২ ২:০৬ : অপরাহ্ণ

প্রথমবারের মতো দুরারোগ্য স্নায়ুরোগ স্পাইনাল মাস্কুলার এট্রফি (এসএমএ) রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হলো জিন থেরাপি। জন্মগত এই রোগের চিকিৎসায় বাংলাদেশে প্রথম কোনও শিশুকে জিন থেরাপি প্রয়োগ করা হলো। এর মাধ্যমে চিকিৎসা বিজ্ঞানের নতুন মাইলফলক স্পর্শ করলো ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতাল।

সংশ্লিষ্টরা এটিকে চিকিৎসা সেবায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন বললেও খরচ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এই চিকিৎসায় ব্যবহৃত ইনজেকশনের মূল্য ২২ কোটি টাকার বেশি। এটি যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় বিনামূল্যে তাকে প্রয়োগ করা হয়েছে।

মঙ্গলবার সকাল ১০টায় শিশু রায়হানকে এ ইনজেকশন দেওয়া হয়। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে তাকে স্যালাইনের মাধ্যমে দুরারোগ্য স্নায়ুরোগ স্পাইনাল মাস্কুলার এট্রফির (এসএমএ) ইনজেকশনটি শরীরে দেওয়া হয়। রায়হান মানিকগঞ্জ সদরের নবগ্রামের বাসিন্দা রফিকুল ইসলামের সন্তান। বাবা-মায়ের বিয়ের ১৩ বছর পর তার জন্ম হয়।

চিকিৎসকরা বলেন, রায়হানকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। আরও কয়েক দিন পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। ওই শিশু সুস্থ হয়ে উঠবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।

রায়হানের শরীরে জিন থেরাপি প্রয়োগের সময় উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব ড. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার, অতিরিক্ত সচিব সাইদুর রহমান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের পরিচালক প্রখ্যাত নিউরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. কাজী দ্বীন মোহাম্মদ, যুগ্ম পরিচালক অধ্যাপক ডা. বদরুল আলম, নোভার্টিসের বাংলাদেশ কান্ট্রি ডিরেক্টর ডা. রিয়াদসহ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তাদের উপস্থিতিতে শিশু রায়হানের শরীরে সফলভাবে ইনজেকশন পুশ করা হয়।

চিকিৎসকরা জানান, স্পাইনাল মাসকুলার এট্রফি একটি বিরল ও জটিল স্নায়ু রোগ যা জন্মগতভাবে মানবদেহে থাকে। জিনগত ত্রুটির কারণে এটা হয়ে থাকে। এ রোগে আক্রান্ত শিশুদের মাংসপেশি ক্রমাগত দুর্বল হতে থাকে। যার ফলে এসব শিশুরা বসতে বা দাঁড়াতে পারে না। তবে তাদের বুদ্ধিমত্তা ঠিক থাকে। পরবর্তীতে শ্বাসতন্ত্রের জটিলতার কারণে আক্রান্ত শিশুরা মৃত্যুবরণ করে।

তারা বলেন, এই রোগের জিন থেরাপি চিকিৎসায় ডোজের মূল্য ২২ কোটি টাকার বেশি। তবে নিউরোসায়েন্স হাসপাতালকে এটি বিনামূল্যে প্রদান করেছে বহুজাতিক ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান সুইজারল্যান্ডের নোভার্টিস কোম্পানি। এই ইনজেকশন আমেরিকায় বাজারজাত করা হয়। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো এই ওষুধ ক্রয় করে থাকে।

যারা দরিদ্র রাষ্ট্র তাদের দেশে এই ওষুধ বিনামূল্যে সীমিত সংখ্যক পাঠানোর জন্য লটারি পদ্ধতি বেছে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এই লটারিতেই বাংলাদেশের অত্যাধুনিক বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের শিশু নিউরোলজি বিভাগ অংশগ্রহন করে। আক্রান্ত কয়েক জন শিশুর শরীরের রক্ত ও চিকিৎসার প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ প্রতিবেদন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়েছিল। লটারিতে সৌভাগ্যবান রায়হানকে নির্বাচিত করা হয়।

রায়হানের মা রিনা আক্তারের বিবাহ হয় ১৩ বছর আগে। তার স্বামী রফিকুল ইসলাম সৌদি আরবে লেবার হিসেবে কাজ করছেন। রায়হানের বয়স ২৩ মাস। গতকাল রায়হানের শরীরে ইনজেকশন পুশ করার পর তার মা রিনা আক্তারের সাথে ইত্তেফাকের এই প্রতিনিধির কথা হয়।

আবেগ-আপ্লুত কণ্ঠে রিনা আক্তার বলেন, স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। কখনো ভাবিনি ২২ কোটি টাকার বেশি মূল্যের ওষুধের চিকিৎসা আমার সন্তানকে করাতে পারবো। এক লাখ টাকা যোগাড় করারই সামর্থ্য নেই।

তিনি বলেন, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের চিকিৎসকদের আমি ধন্যবাদ জানাই। তাদের চেষ্টার কারণেই আমার কলিজার ধনকে সুচিকিৎসা দিতে পারছি। এটা আমার প্রথম সন্তান।

রায়হানের শরীরে ইনজেকশন পুশ করার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতাল একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, বিরল স্পাইনাল মাস্কুলার এট্রফি রোগের এই দামি ওষুধ যাতে হাতের কাছে পাওয়া যায় এবং সহজলভ্য হয় সেই চেষ্টা তারা করবেন।

১০ থেকে ১২ হাজার শিশুর মধ্যে একজন শিশু এই বিরল রোগে আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু সংখ্যক শিশু এই রোগে আক্রান্ত। দুই বছরের মধ্যে আক্রান্ত শিশুরা মারা যায়। শুধুমাত্র ওই ইনজেকশনটি দিলেই বেশিরভাগ শিশু বেঁচে যায়। দুটি খারাপ জিন এক সাথে হলে এই রোগ হয়। এছাড়াও অন্যান্য জটিল রোগও হতে পারে।

গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিকট আত্মীয়দের মধ্যে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন তাদের মধ্যে আক্রান্তের হার বেশি। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা নিকট আত্মীয়দের মধ্যে বিবাহ নিরুৎসাহিত করেছেন।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব ড. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, দেশে প্রথমবারের মতো জিন থেরাপি চিকিৎসা হয়েছে। এটি আমাদের জন্য বড় একটি আশার দিক। কিন্তু এর যে ব্যয়, সেটি আসলে রোগীদের জন্য বহন করা সম্ভব না। আমরা চাইলেও এ নিয়ে কিছু করতে পারছি না।

সচিব বলেন, আমরা আশা করছি একটা পর্যায়ে ওষুধটির দাম কমে যাবে। আমাদের হাতের নাগালে নেমে আসবে। তখন আমরা এই চিকিৎসা আমাদের দেশে নিয়মিত করতে পারবো।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী দ্বীন মোহাম্মদ বলেন, নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের ১০ বছরের ইতিহাসে একটা ঐতিহাসিক দ্বার উন্মোচন হয়েছে। একটা বাচ্চাকে নিশ্চিত মৃত্যু থেকে আমরা বাঁচার সুযোগ করে দিয়েছি। সে এখন নিশ্চিতভাবে আকাশ দেখতে পারবে, নিঃশ্বাস নিতে পারবে। এজন্য আমরা আনন্দিত ও গর্বিত।

সূত্র—ডিই/এসএস/এমএফ

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ