বিষয় :

করোনা কালে চরম অনিশ্চয়তায় রেমিট্যান্সযোদ্ধারা


নূর মোহাম্মদ রানা ৩ অক্টোবর, ২০২০ ১২:৪০ : অপরাহ্ণ

মহামারি করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিপর্যস্ত সারাবিশ্ব। অতীতে মানবজাতি বিভিন্ন সময় বড় বড় সংকটে পড়লেও একসঙ্গে বিশ্বজুড়ে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। তবে এবার সারাবিশ্ব একসঙ্গে মোকাবেলা করেছে করোনার ভয়াবহতা। যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতিতে। বিশেষ করে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। কেননা এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে আটকে পড়া ও চাকরি হারিয়ে দেশে ফেরা প্রবাসী রেমিট্যান্সযোদ্ধারা রয়েছেন মহাসংকটে।

দীর্ঘদিন ধরে কাজের বাইরে থাকা এসব প্রবাসী আর্থিক সংকটে দিন কাটাচ্ছেন। আমাদের প্রবাসী শ্রমিকদের বলা হয় রেমিট্যান্সযোদ্ধা। সাধারণত তাঁদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতির ভিত গঠনে সহায়তা করে। তাঁদের এই রেমিট্যান্স এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতি। কিন্তু বৈশ্বিক এই করোনা মহামারির প্রভাবে সেই প্রবাসী শ্রমিকরা চোখে অন্ধকার দেখছেন।

কাজ হারিয়ে বা ছুটিতে দেশে এসে আর ফিরে যেতে না পারার দুশ্চিন্তায় দিন অতিবাহিত করছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী করোনা সংক্রমণের ফলে চাকরি হারানোসহ নানা কারণে বিভিন্ন দেশ থেকে ফেব্রুারির মাঝামাঝি থেকে মার্চে ফ্লাইট চলাচল বন্ধের আগ পর্যন্ত সাড়ে চারলাখ লোক বিদেশ থেকে এসেছেন। এর মধ্যে অন্তত দেড় থেকে দুই লাখ প্রবাসী কর্মী। এর মধ্যে সৌদি আরব থেকে ৪১ হাজার ৬৬১, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ৩৭ হাজার ৩২১, মালয়েশিয়া থেকে ১৮ হাজার ৯৪২, কাতার থেকে ১৩ হাজার ৮৬৫, সিঙ্গাপুর থেকে ১২ হাজার ৩৪২, ওমান থেকে ১১ হাজার ৭৮৪, কুয়েত থেকে ৬ হাজার ১২০, বাহরাইন থেকে ৩ হাজার ৫৫৪ জন, ইতালি থেকে ২ হাজার ৭০৩, মালদ্বীপ থেকে ১৫০৯ জন দেশে এসেছিলেন।

এঁদের বড় অংশই প্রবাসী কর্মী, যাঁরা আবার কাজে ফিরতে পারবেন কি না নিয়ে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন। কারণ অনেকের ভিসার মেয়াদ শেষ, অনেকের মালিক কোন আশ্বাস দিচ্ছেন না। আর করোনার আগে পরে দেশে ফেরা প্রবাসীরা পরিবার নিয়ে আর্থিকসহ নানাবিধ সমস্যায় দিন কাটাচ্ছেন। দেশে বসে বসে পুঁজি ভেঙে খাচ্ছেন অনেকেই। আবার অনেকেই লম্বা ছুটিতে পড়ে যাওয়ায় ধারদেনা করে চলছেন। এ যেমন বোঝার উপর শাকের আঁটি।

তাঁরা বলছেন, আগামীর দিনগুলোর চরম অনিশ্চয়তা নিয়ে দিন কাটছে তাঁদের। বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের যত লোক বিদেশে যান, তাঁদের মধ্যে চিকিৎসক, প্রকৌশলী বা পেশাদার লোকের সংখ্যা মাত্র দুই শতাংশ। এঁরা মাস গেলে বেতন পান, ফলে খুব দুশ্চিন্তা করতে হয় না। বাকি যাঁরা আছেন তাঁরা অদক্ষ বা আধাদক্ষ। তাঁদের বেতন হয় কাজের ওপর। নির্মাণ শ্রমিক, পরিচ্ছন্নকর্মী বা ছোটখাটো প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন তাঁরা। করোনা ও লকডাউনের কারণে কাজ বন্ধ থাকায় তাঁরা আছেন সংকটে। এ ছাড়া যাঁরা ছোটবড় ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন, তাঁদেরও ব্যবসা ক্ষতির মুখে।

আর যাঁদের বৈধ কাগজপত্র নেই তাঁদের সংকটের তো শেষ নেই। করোনার কারণে যাঁরা দেশে আসতে বাধ্য হয়েছেন তাঁরা যেমন বিপদে পড়েছেন; তেমনি যাঁরা বিদেশে রয়ে গেছেন তাঁরাও ভবিষ্যত অন্ধকার দেখছেন। কোনো কিছুতেই আশ্বস্ত হতে পারছেন না কাজ করতে পারবেন কি না তা নিয়ে! অথচ এদের অধিকাংশই জমি-বাড়িঘর বিক্রি করে এবং ব্যাংকে ঋণ নিয়ে বিদেশ গেছেন। এঁদের অনেকেই এই ঋণ পরিশোধ করতে পারবে কি না তা ভেবে দুচোখের ঘুম হারাম করছেন, এবং সর্বদা এই চাপে দিন পার করছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের অর্থনীতির প্রধান চার খুঁটির একটি হচ্ছে প্রবাসী আয়। পৃথিবীর ১৬৯টি দেশে এক কোটি ২২ লাখ প্রবাসী আছেন। গত অর্থবছরে প্রবাসী শ্রমিকরা বৈধপথেই রেকর্ড পরিমাণ ১৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন।

হুন্ডি এবং অন্যান্য পথে পাঠানো টাকা হিসাবে আনলে এর পরিমাণ আরও ৪-৫ বিলিয়ন ডলার বেশি হয়। এটা আমাদের জন্য বড় অর্জন। দেশের অর্থনীতিতে এর সুফল পড়ছে। দেশ সমৃদ্ধ হয়েছে এই রেমিট্যান্সের প্রভাবে। মূলত করোনার প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিকদের ওপর। কেননা করোনাকালীন এই সময়ে চাকরি বা কাজ হারিয়েছেন অনেক প্রবাসী শ্রমিক। এরই মধ্যে কুয়েত, বাহরাইন, মালদ্বীপসহ বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশি কর্মী ফেরত আনার জন্য তাগাদা দেয়া হচ্ছে। অবশ্য কোভিড-১৯ শুধু প্রবাসীদের জীবিকাতেই নয়, আঘাত করেছে জীবনেও। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন ও বিভিন্ন দূতাবাসের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, করোনার কারণে বিদেশে ইতিমধ্যেই এক হাজার ৩৮০ জন প্রবাসী বাংলাদেশি মারা গেছেন।

এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের ছয় দেশেই ৭৫৩ বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে। শুধুমাত্র সৌদি আরবেই মারা গেছেন ৫২১ জন বাংলাদেশি। এছাড়া প্রায় ৭০ হাজার বাংলাদেশি বিভিন্ন দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে আশাজাগানিয়া খবর হলো, করোনা পরিস্থিতিতে চাকরি হারিয়ে কিংবা দেশে এসে আটকে পড়া প্রবাসীদের অনেকেই উদ্যোক্তা হওয়ার আগ্রহ দেখাচ্ছেন। তবে এ ক্ষেত্রেও বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। তাঁরা বলছেন, ঋণপ্রাপ্তির জটিলতায় সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে হচ্ছে তাঁদের।

ব্যাংকের শর্তে সংশয়ে পড়ছেন তাঁরা। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, করোনার কারণে চাকরিচ্যুত হয়ে কিংবা অন্য কোনো কারণে বিদেশফেরত কর্মীদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের জন্য প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের অনুকূলে ৫০০ কোটি টাকার বরাদ্দ অনুমোদন করা হয়েছে। এছাড়া প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের মাধ্যমে স্বল্পসুদে ও সহজ শর্তে বিনিয়োগ ঋণ প্রদানের জন্য ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড থেকে ২০০ কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হয়েছে।

তবে এই ঋণ নিয়ে প্রবাসীরা আসলেই ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন কী না তা নিয়েও শঙ্কা আছে। এক্ষেত্রে তাঁদের টেকসই পুনরেকত্রীকরণের জন্য সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলো সমন্বিত উদ্যোগ নিতে পারে। যেমন তাঁদের কল্যাণে ছোটছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়া যায়। আর ফেরত আসা দক্ষ লোকজনকে দেশের ভেতরেই চাকরি দেওয়া যায়। তাহলে উদ্যোগ ফলপ্রসু হবে। তবে একটা বিষয় সবাইকে মনে রাখতে হবে, করোনা একট স্বাস্থ্যখাতের সমস্যা। একটি মহামারি।

কাজেই বাংলাদেশকে করোনামুক্ত করতে হবে পৃথিবীর সব দেশের সঙ্গে। নয়তো বাংলাদেশিদের চলাচল নিয়ন্ত্রিত হয়ে যেতে পারে। কেননা ‘বিদেশফেরত অভিবাসী কর্মীদের জীবন ও জীবিকার ওপর কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাব’ শীর্ষক জরিপে জানা যায়, কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারির সময়ে দেশে ফেরত আসা অভিবাসী কর্মীদের ৮৭ শতাংশেরই কোনও আয়ের উৎস নেই। ৭৪ শতাংশ জানিয়েছেন, তাঁরা এখন প্রচন্ড দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও ভীতির মধ্যে রয়েছেন। ৩৪ শতাংশ জানিয়েছেন, তাঁদের নিজেদের সঞ্চয় বলতে এখন আর কিছু নেই। ৯১ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা সরকারি বা বেসরকারি কোনো সহায়তা পাননি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে বলেছেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে প্রবাসী শ্রমিকদের ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য কূটনৈতিক চাপ অব্যাহত রয়েছে। তবে এ চাপ প্রশমিত করার জন্য আমাদের সরকার বিভিন্নমুখী কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। পাশাপাশি বিদেশফেরতদের জনও নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তবে সংকটময় এই সময়ে রাষ্ট্রসহ সবার প্রবাসীদের পাশে থাকাটা জরুরী।

কারণ এক কোটিরও বেশি প্রবাসী রাষ্ট্রকে শুধু দিয়েই যাচ্ছেন, সে তুলনায় তাঁদের প্রাপ্তি নেই বললেই চলে। করোনার এই সংকটময় সময়ে তাঁদের পাশে থেকে ঋণশোধ করার চেষ্টা করতে পারে বাংলাদেশ। পাশাপাশি অভিবাসন খাতকে স্বাভাবিক করা ও করোনা-পরবর্তী নতুন পৃথিবীর জন্য যেসব খাতে দক্ষ লোকের দরকার সেই প্রস্তুতিও নিতে হবে এখুনি। কারণ, করোনা-পরবর্তী পৃথিবীতে ভালো খবরও নিশ্চয়ই থাকবে।

এ ছাড়াও বর্তমানে সরকারি তরফ থেকে প্রবাসীদের পুনর্বাসনের জন্য নানা প্রকল্প গঠন ও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তাতেও লাখ লাখ প্রবাসী শ্রমিকের আগামীর অনিশ্চয়তার কথা ভেবে রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। ভিসার মেয়াদ বাড়ানো, বিলম্বে কাজে যোগদানের জন্য ছুটি বাড়ানো ইত্যাদির উদ্যোগের কথা শোনা গেলেও প্রবাসী শ্রমিকরা আশ্বস্ত হতে পারছেন না। তাঁদের বক্তব্য এসব শুধুই কথার কথা, বাস্তবের সঙ্গে মিল নেই। বিশেষজ্ঞ ও খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তরুণ-যুবকরা যাতে প্রবাসে থেকে কাজ করে রেমিট্যান্স পাঠাতে পারেন সে জন্য সরকারের এখনই পদক্ষেপ নেয়া উচিত।

রেমিটেন্সযোদ্ধারা যাঁরা যে দেশে ছিল তাঁরা যাতে সে দেশে থেকে কাজ করতে পারেন সে জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা শুরু করা দরকার। কাজ হারিয়ে শ্রমিকরা দেশে ফিলে আসতে বাধ্য হলে এসব মানবসম্পদ সরকারের বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। তাই তাঁদের পাশে থেকে সঠিক সমাধানের ব্যবস্থা করলে প্রবাসী রেমিট্যান্সযোদ্ধারা আবার রেমিট্যান্স পাঠাতে পারবেন এবং এর ফলে দেশ সমৃদ্ধশালী হবে এবং প্রবাসীদের পরিবার অনিশ্চয়তার ঘোর অন্ধকার কাটিয়ে উঠতে পারবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, সাংবাদিক

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ