বিষয় :

কে এই মধুকুঞ্জের পিয়াসা!


সকালের-সময় রিপোর্ট  ৭ আগস্ট, ২০২১ ২:১৬ : পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের মেয়ে ফারিয়া মাহাবুব পিয়াসা। তিনি আসকার দীঘির পাড়ের সাধারণ এক নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। তার বেড়ে উঠা নগরীতে হলেও  গ্রামের বাড়ি পটিয়া। শখের বশে গান, রঙ-তুলি হাতে ছবি আঁকা, মডেলিং করে রাতারাতি সুনাম কুড়িয়েছে এই মেধাবী কিশোরী।

‘মিস চট্টগ্রাম’ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে অনেকের নজরে এসে মন কেড়েছেন। কলেজ জীবন থেকে জড়িয়ে পড়ে প্রেমে, সেটাতেও ব্যর্থ হন তিনি। এরপর পাড়ি জমান ঢাকায়। রকেট গতিতে ‘উপরে উঠা’র সিঁড়ি খোঁজেন। বিনোদনজগতে ঠাঁই পেতে মরিয়া হয়েও তাতে ব্যর্থ হন। তখন রঙিন জগতে টিকে থাকার নেশায় হন বিপথগামী।

কাড়ি কাড়ি টাকার গন্ধ, ভোগ-সম্ভোগ, বিলাসিতা আর নীল মাদকের উগ্র নেশা ও নিষিদ্ধ পেশা তাকে পেয়ে বসে। চট্টগ্রামের আসকার দীঘির পাড় আর কে মিশন গলির সেই পিয়াসা অধ্যায় পেছনে পড়ে যায়। দিনে দিনে বহু ঘটনা-অঘটনের হোতা অন্ধকার রঙিন ভুবনের বিপথগামী ৩২ বছরের তরুণী। অন্য এক পিয়াসা হয়ে উঠেন। যা হিন্দি সিনেমার ভ্যাম্প চরিত্রকেও হার মানায়।

পিয়াসাকান্ড ও তাকে গ্রেফতারের খবর জানাজানি হওয়ার পর থেকে গতকাল শুক্রবারও তার নিজ শহর চট্টগ্রামে বিশেষ করে আসকার দীঘি এলাকার পাড়া-প্রতিবেশী, পরিচিতজনেরা এই ঘটনায় রীতিমত অবাক। পিয়াসাদের বাড়ির আশপাশের লোকজন এখন বিব্রত।

চট্টগ্রামের আরো আট-দশটা রক্ষণশীল মূল্যবোধসম্পন্ন পরিবার বলেই তারা পিয়াসাদের পরিবারটিকে জানতেন। অথচ সাধারণ পরিবারের মেয়ের এমন কদর্য পরিণতিতে অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করছেন। এখানে-সেখানে মুখে মুখে কেচ্ছা চর্চা চলছে।

পারিবারিক সূত্র জানায়, পিয়াসার বাবা মাহাবুবুল আলম সাবেক ফুটবলার। খেলোয়াড় কোটায় তিনি চট্টগ্রাম বন্দরে চাকরি করতেন। জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে চাকরি থেকে অবসরে যান। মা নব্যুয়াত আরা সিদ্দিকী রকি গৃহিণী ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেত্রী। তাদের তিন কন্যা সন্তানের মধ্যে পিয়াসা বড়।

পিয়াসাদের এক প্রতিবেশী বলেন, একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েটি শুধুই সময় থাকতে গাইড পায়নি। বিপথে গেল। পিয়াসার বিচারের পাশাপাশি যারা একেকটি পিয়াসা তৈরি করে কতিপয় ধনাঢ্য নারীলিপ্সুর মুখোশ উম্মোচন ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া জরুরি। পিয়াসার চট্টগ্রাম কানেকশনে পুলিশ এখন চিহ্নিত এবং সন্দেহভাজনদের হন্যে হয়ে খুঁজছে।

চট্টগ্রাম শহরের অনেকেই তার পার্টিতে ছুটে যেতেন। তাছাড়া চট্টগ্রামের খুলশী, হালিশহর, আগ্রাবাদে পিয়াসা ও তার সহযোগিদের কোথায় আসা-যাওয়া ছিল, কাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হতো এ নিয়ে অনুসন্ধান চালাচ্ছেন পুলিশসহ গোয়েন্দারা।

জানা গেছে, গেল রবিবার ছিল পিয়াসার জন্মদিন। বার্থ ডে পার্টির জমকালো আয়োজনের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার সময়েই অভিজাত বারিধারা এলাকায় তার বাসায় হাজির হয় পুলিশ। পিয়াসার জন্য সবসময়ই দিনের বেলাটা ছিল রাত, আর রাত মানে তার ঝলমলে রঙিন দিন। রাতভর দামি ব্রান্ডের মদ ও নানান মাদকদ্রব্য সেবন, ক্যাসিনো জুয়ার আসর, আমোদ-ফূর্তির জোয়ারে ভাসতো তার নাচ-গানের ডিজে পার্টি।

বারিধারা ছাড়াও গুলশান, বনানীতে বসতো ডিজে পার্টি। আর সেখানে পূর্ব-পরিকল্পনা মাফিক ধনীর দুলালদের টার্গেট করেই জড়ো করানো হতো। বিভিন্ন প্রলোভনে আকৃষ্ট হয়ে এসব তরুণরা মধুকুঞ্জে ভিড়তেন। এরপর পিয়াসার সহযোগীরা মাতাল ও বেসামাল অবস্থায় ধনীর তনয়দের পার্টিকান্ড ভিডিও ধারণ করে রাখতো। এ ধরনের বেশকিছু ভিডিও ফুটেজ ও সিসিটিভি ফুটেজ পুলিশের হাতে এসেছে।

পরবর্তী সময়ে সেসব ভিডিও ফুটেজ টার্গেটেটেড তরুণদের মা-বাবাসহ পরিবার-পরিজনের কাছে অথবা সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানোর হুমকি দিয়ে দিনের পর দিন ব্যাকমেইলিং করেই মোটা দাগে অর্থ আদায় করতো পিয়াসা ও তার দলবল। ব্যাকমেইলিং কর্মকান্ডে পিয়াসার অস্ত্র বা ফাঁদ ছিল একশ’ সুন্দরী।

রাতভর পিয়াসার বাড়িটিতে বসতো সুন্দরীদের হাট। এদেরকে দিয়ে ‘শিকার’ কব্জা করা এবং টাকা আদায়ের ফাঁদ পাতা হতো। অনেক ধনাঢ্য পরিবারের তরুণ পিয়াসার পাতা জালে পা বাড়িয়ে অর্থকড়ি লোপাট ছাড়াও মানসিক যাতনায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন।

অনেকেই বলেন, পিয়াসার হাত অনেক লম্বা। বাঘা বাঘা ব্যবসায়ী-শিল্পপতি থেকে শুরু করে ঢাকার অভিজাত মহলে অনেকেই তা জানতেন। সেই পিয়াসাই হঠাৎ করে ধরা পড়ার পর বিস্মিত অনেকেই হিসাব মেলাতে পারছেন না।

অভিজাত ফেরারি, বিএমডাব্লিউ, মার্সিডিস গাড়ি ব্যবহার, বারিধারার মতো অভিজাত এলাকায় আড়াই চার হাজার স্কয়ার ফুটের বাসা, সব মিলিয়ে অভাবনীয় বিলাসবহুল জীবনযাপনে তার অঢেল টাকার কী উৎস? এই প্রশ্নে পুলিশসহ গোয়েন্দারা রীতিমতো বিস্মিত। এর কোন সদুত্তর দিতে পারেননি পিয়াসা।

চট্টগ্রামে তার পরিবারটিকে চেনেন এমন ব্যক্তিরা জানান, কিশোরবেলায় পিয়াসার প্রেমে পড়ে। ভেঙ্গে গেলে বেদনায় মুষড়ে পড়ে। এসব ভুলে পড়ালেখায় মনোযোগী হতে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় ঢাকার উত্তর বাড্ডার মামার বাড়িতে। যাওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর নজরে পড়ে পিয়াসা।

বদলে যায় তার জীবন। কাড়ি কাড়ি টাকা। মামার বাসা ছেড়ে উঠে যায় অভিজাত ফ্ল্যাট বাড়িতে। ঘন ঘন দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ানো। ঈচ্ছে মতো শপিং। এ যেন আলাদিনের চেরাগ। মধ্যবিত্ত পরিবারে টানাপোড়েনে বড় হওয়া পিয়াসা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পায়। এরপর একের পর এক সঙ্গি বদল।

রূপালি পর্দায় নিজেকে দেখার স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে উঠা পিয়াসা ধীরে ধীরে হারিয়ে যায় অন্ধকার এক জগতে। পরিবারের পক্ষ থেকে প্রথমে কিছুটা বাধা আসলেও অর্থের জোয়ারে তা থেমে যায়। দিনে দিনে বেপরোয়া হয়ে উঠে পিয়াসা। ডিবির হাতে পিয়াসা গ্রেফতারের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা কাহিনী উঠে আসছে।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারাও তার অনেক অপকর্মের কাহিনি প্রকাশ করেন। পিয়াসার বিরুদ্ধে মামলার তদন্তকারী সংস্থা ডিবির কর্মকর্তারা তার বিষয়ে চট্টগ্রামের ডিবি পুলিশের কাছে খোঁজখবর নিচ্ছেন। নগর পুলিশের দুই জন উপ-কমিশনার জানান, পিয়াসার সাথে চট্টগ্রামের কোন কোন তরুণ ব্যবসায়ী ও কিছু উঠতি ধনীর সম্পর্ক ছিলো।

তার বারিধারার বাসায় যাতায়াতও ছিলো। তাদের ব্যাপারে খোঁজ খবর নেয়া হচ্ছে। তবে মামলা তদন্তের স্বার্থে ওইসব ব্যবসায়ীদের নাম প্রকাশ করতে চাননি নগর পুলিশের কর্মকর্তারা।

পারিবারিক সূত্র জানায়, পিয়াসা ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেন। চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। কলেজেই এক সিনিয়রের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক হয় তার। তবে তা দুই পরিবারের অজানা ছিলো। একদিন ওই প্রেমিক ও এক বন্ধুর সাথে পতেঙ্গা সৈকতে বেড়াতে যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় পড়ে।

এতে তার বন্ধু মারা যায়। প্রেমিকসহ পিয়াসা আহত হয়। তখনই তাদের প্রেমের ঘটনা জানাজানি হয়। প্রেমিকের বাবা নগরীর মাদারবাড়ি এলাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। আর পিয়াসার পরিবার মধ্যবিত্ত।

প্রেমিকের বাবা এই সম্পর্ক মেনে নিতে অস্বীকার করেন এবং এক সপ্তাহের মধ্যে অন্য এক ধনাঢ্য পরিবারের মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে দেন। তখনও হাসপাতালে পিয়াসা। এই ঘটনায় পিয়াসা চরমভাবে ভেঙ্গে পড়ে। নতুন জীবন শুরু করতে পাঠানো হয় মামার বাড়ি। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে ভর্তিও করা হয়।

তবে ছয় মাসের মধ্যে একটি কোম্পানিতে চাকরি পাওয়ার কথা বলে পিয়াসা মামার বাসা ছেড়ে দেন। এক ব্যবসায়ীর দেওয়া ফ্ল্যাটে উঠেন। তার পরিবার বিষয়টি জানলেও ভাল চাকরি পাওয়ার খবরে খুশি হয়। তবে ঢাকায় তার মামারা সব জেনেও চুপ থাকতেন। বরং তারা বিভিন্ন সময় তার কাছ থেকে টাকা পয়সাও নিতেন।

রঙিন জগতে আমোদ-ফুর্তির আড়ালে ব্যাকমেইলিংয়ের অনেক ঘটনায় সমালোচনায় উঠে আসে পিয়াসা ও তার সহযোগিদের নাম। ২০১৭ সালে মে মাসে বনানীর রেইনট্রি হোটেলে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হন। ওই ঘটনায় মামলার এজাহারে আসে পিয়াসার নাম। প্রথমদিকে পিয়াসা ভিকটিমকে মামলা করতে উৎসাহ জোগান।

পরে পিয়াসা নিজেই যখন ফেঁসে যাচ্ছিলেন তখন ভিকটিমকে উল্টো হুমকি দেন। তখন ভিকটিমই তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। পরবর্তী সময়ে তার বিতর্কিত ও কর্মকান্ডে প্রমাণিত হয় পিয়াসাই এ ঘটনার অন্যতম হোতা। যার নেপথ্যে পিয়াসারই ব্যাকমেইলিং কারবারের ফাঁদ।

তাছাড়া গুলশানের ফ্ল্যাট থেকে মোসারাত জাহান মুনিয়ার লাশ উদ্ধারের পর যে মামলা হয় তাতেও পিয়াসার নাম ছিল। অন্ধকার অপরাধ জগতে নানাভাবে উচ্চারিত ও সমালোচিত পিয়াসা। অথচ কীভাবে দীর্ঘদিন রঙিন জগতের আড়ালে পিয়াসা এতোসব কুকীর্তি নির্বিঘ্নে চালিয়ে আসছিলেন এটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এসএস

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ