১৭৪ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিতে আকিজ ফুডের নানা টালবাহানা!


নিজস্ব প্রতিবেদক ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ১১:৪২ : পূর্বাহ্ণ

দীর্ঘদিন ধরে এনার্জি ড্রিংক স্পিড বিক্রি করে আসছে আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড। এতে প্রযোজ্য সম্পূরক শুল্ক ৩৫ শতাংশ। কিন্তু প্রতিষ্ঠান বলছে, সম্পূরক শুল্ক হবে ২৫ শতাংশ। সঙ্গে রয়েছে ১৫ শতাংশ ভ্যাট। ৩৫ আর ২৫ শতাংশের বিতর্ক গড়ায় আদালতে। শেষমেশ আদালত ৩৫ শতাংশ বহাল রাখেন। এতে মাত্র এক বছরে সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাট দাঁড়ায় প্রায় ১৭৪ কোটি টাকা।

আদালতের রায়ের পরও স্পিড বিক্রিতে প্রযোজ্য এ রাজস্ব পরিশোধ করছে না ‘আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড’। সব আইনি প্রক্রিয়া শেষেও প্রযোজ্য রাজস্ব পরিশোধ না করায় আকিজ গ্রুপের প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

এনবিআরের আওতাধীন বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ) থেকে ৪৬টি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর এ-সংক্রান্ত চিঠি দেয়া হয়েছে। বকেয়া পরিশোধ না করলে প্রতিষ্ঠানটির হিসাব থেকে অর্থ কেটে সরকারি কোষাগারে জমা করতে ব্যাংকগুলোকে অনুরোধ করা হয়।

তবে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ বলছে, স্পিড এনার্জি ড্রিংক নয়, এটি কার্বোহাইড্রেট বেভারেজ। এটি যে কার্বোহাইড্রেট বেভারেজ, বিএসটিআই’র সনদ রয়েছে। এনার্জি ড্রিংক হিসেবে রাজস্ব দাবি করা হয়েছে।

সূত্রমতে–আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড এলটিইউ’র অধীন একটি বেভারেজ জাতীয় পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি মিনারেল ওয়াটার, কোমল পানীয়, এনার্জি ড্রিংক, ফার্ম ফ্রেশ লিকুইড মিল্ক, ফ্রুট জুস ইত্যাদি তৈরি করে। ২০১৮-১৯ অর্থবছর বাজেটে এনার্জি ড্রিংকের ওপর সম্পূরক শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ বাড়িয়ে ৩৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়।

২০১৮ সালের ৭ জুন এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। যাতে বলা হয়, এনার্জি ড্রিংক (২০১৮ সালের ৬ জুন বা তার পূর্বে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ও বাজারজাতকৃত ওইসব ব্র্যান্ডের পানীয়, যার লেবেলে বর্ণিত উপাদানে কিংবা প্রকৃত পক্ষে এনার্জির পরিমাণ প্রতি ১০০ মিলিলিটারে ৬০ কিলোক্যালরির কিংবা ততোধিক এবং ভবিষ্যতে উৎপাদিত ও বাজারজাতকৃত এইরূপ মাত্রার এনার্জি সম্বলিত ড্রিংক) এর সম্পূরক শুল্ক ৩৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়।

সূত্র আরও জানায়– এসআরও জারির পর এলটিইউ থেকে চিঠি দিয়ে আকিজ ফুডকে জানানো হয়। যাতে বলা হয়, আকিজ ফুডের উৎপাদিত এনার্জি জাতীয় পণ্য স্পিডের ক্ষেত্রে সম্পূরক শুল্ক ৩৫ শতাংশ হারে কার্যকর হবে। প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ এসআরও’র নির্দেশনা পরিপালন না করে বিষয়টি নিয়ে ২০১৮ সালে উচ্চ আদালতে রিট করে। একইসঙ্গে স্পিড নামের পণ্যের সম্পূরক শুল্ক ২৫ শতাংশের স্থলে ৩৫ শতাংশ হারে পরিশোধ ছাড়াই ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করে যা এসআরও এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

২০২১ সালের ১১ জানুয়ারি হাইকোর্ট বিভাগ সরকারের পক্ষে রায় দেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান আপিল বিভাগে সিভিল পিটিশন দায়ের করে। চলতি বছরের ১৯ জুন আপিল বিভাগ প্রতিষ্ঠানের আপিল খারিজ করে দেন। সুপ্রিম কোর্টের দুই বিভাগের রায় অনুসারে আকিজকে ৩৫ শতাংশ হারে সম্পূরক শুল্ক দিতে হবে।

সূত্র আরও জানায়–এ রায় অনুযায়ী এলটিইউ’র গঠিত টিম ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত (এক বছরে) স্পিড বিক্রির তথ্য সংগ্রহপূর্বক যাচাই করে প্রতিবেদন দেয়। যাতে দেখা যায়, এক বছরে প্রতিষ্ঠানটি এনার্জি ড্রিংক স্পিড বিক্রি বা সরবরাহের ক্ষেত্রে ৭২ কোটি ৬৩ লাখ ৩৩ হাজার ৫৫৪ টাকা সম্পূরক শুল্ক ও ১০ কোটি ৮৯ লাখ ৫০ হাজার ৩৩ টাকা ভ্যাটসহ মোট ৮৩ কোটি ৫২ লাখ ৮৩ হাজার ৫৮৮ টাকা পরিশোধ করেনি।

সুদসহ রাজস্ব ১৭৪ কোটি ২৬ লাখ ৪৯৯ টাকা। এ ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক পরিশোধে ২০২১ সালের ২৮ অক্টোবর মূসক আইন, ১৯৯১ অনুযায়ী প্রাথমিক দাবিনামা সম্বলিত কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হয়। প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ রাজস্ব পরিশোধ না করায় চলতি বছরের ১৯ জুলাই মূসক আইন, ১৯৯১ অনুযায়ী চূড়ান্ত দাবিনামা জারি করা হয়।

তবুও প্রতিষ্ঠান এ রাজস্ব পরিশোধ করেনি। মূসক আইন, ১৯৯১-এর ধারা ৫৫(৪) অনুযায়ী প্রতিষ্ঠান বকেয়া এ রাজস্ব পরিশোধে কিস্তি সুবিধা গ্রহণে আগ্রহী কি না এ বিষয়ে জানতে আবার চিঠি দেয়া হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ কোনো জবাব দেয়নি। পরে আইন অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানকে দুটি নোটিশ জারি করা হয়। কিন্তু ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ সরকারি কোষাগারে কোনো রাজস্ব পরিশোধ করেনি।

এনবিআর সূত্রমতে, আইন অমান্য করায় মূসক আইনের ২৬ ধারার উপধারা (৪) অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করার সিদ্ধান্ত নেয় এলটিইউ। সে অনুযায়ী ১৯ সেপ্টেম্বর ৪৬টি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে চিঠি দেয়া হয়।

যাতে বলা হয়, যেহেতু প্রতিষ্ঠানটি নিরঙ্কুশ সরকারি পাওনা বাবদ ভ্যাট পরিশোধে বিরত রয়েছে, সেহেতু রাজস্বের জরুরি প্রয়োজনে মূল্য সংযোজন কর আইন, ১৯৯১-এর ধারা ২৬-এর উপধারা ৪ অনুযায়ী, আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড কর্তৃক পরিচালিত ব্যাংক হিসাব আগামী ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত অপরিচালনযোগ্য (ফ্রিজ) করার জন্য বলা হলো।

একই সময়ে এ ব্যাংক অ্যাকাউন্টের স্থিতি হতে বা অ্যাকাউন্টের বিপরীতে আপনার ব্যাংকে আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের অন্য কোনো এফডিআর, ফিক্সড ডিপোজিট, এসটিডি, ট্রেজারি বন্ড ইত্যাদি যদি থাকে তা হতে সরকারি পাওনা কর্তন করে সরকারি কোষাগারে জমা প্রদান করে এই দপ্তরকে অবহিত করার অনুরোধ করা হলো।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে আকিজ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেখ বশির উদ্দিনের ব্যক্তিগত নাম্বারে ফোন দেয়া হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।

সূত্র–এসবি/সকালের-সময়/ফোরকান

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ