হরিলুটের কারখানা কর্ণফুলী গ্যাস–এমডিকে শোকজ


নিজস্ব প্রতিবেদক ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ৭:৫৮ : অপরাহ্ণ

অবশেষে কেজিডিসিএল’র (কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড) দুর্নীতির বরপুত্র খ্যাত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ মাজেদকে শোকজ করা হয়েছে। পেট্রোবাংলা গঠিত উচ্চ পর‌্যায়ের তদন্ত কমিটি দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ পাওয়ায় চাকরি থেকে অব্যাহতি প্রদানের সুপারিশের প্রেক্ষিতে ওই শোকজ করা হয়েছে।

পেট্রোবাংলার একজন পদস্থ কর্মকর্তা এম এ মাজেদসহ দুর্নীতিবাজ কয়েকজন কর্মকর্তাকে শোকজ করার কথা নিশ্চিত করেছেন। তবে তিনি তার নাম প্রকাশ করতে আপত্তি জানিয়েছেন।

পেট্রোবাংলারা পরিচালক (প্রশাসন) মোঃ আলতাফ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেছেন, তদন্ত রিপোর্টের প্রেক্ষিতে প্রশাসনিক করণীয় গ্রহণ করা হয়েছে। আপাতত এর বেশি বলতে পারবো না। কি ধরণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সময় হলেই সবকিছু জানানো হবে।

বন্দরনগরী চট্টগ্রাম অঞ্চলে গ্যাস বিতরণের দায়িত্বে থাকা কেজিডিসিএল’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগ পাওয়ার পর ঘুষ দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে পড়েছেন এমএ মাজেদ।

আইনকানুনের কোন বালাই নেই তার কাছে। টাকা ঢাললেই সবকিছু মেলে, রাতকে দিন আর দিনকে রাত বানাতে সিদ্ধহস্ত তিনি। কোন কোন কোম্পানির আবেদন কয়েক বছর ধরে ঝুলে রয়েছে। কেউ কেউ কর্ণফুলীতে ঘুরতে ঘুরতে জুতার তলা ক্ষয় করে ফেলেছেন তবুও সংযোগ পাননি। আবার ঘুষ ঢালায় একদিনেই সংযোগ পাওয়ার নজির তৈরি করেছেন।

মেসার্স মোস্তফা পেপার কমপ্লেক্স লিমিটেড (গ্রাহক সংকেত শিল্প-৫১৫১) আবেদন করেছেন ২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর। পর দিনেই (২০ ডিসেম্বর) তাকে সংযোগ প্রদান করা হয়। সব ধরনের আইন অমান্য করে মাত্র সেই সংযোগটিও প্রদান করা হয়েছে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত ক্যাপটিভ পাওয়ারে।

মেসার্স মোস্তফা পেপার কমপ্লেক্স লিমিটেড ৯০০কিলোওয়ার্ট ক্ষমতার ক্যাপটিভের আবেদনটি বোর্ডে তোলার বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু সেই বিধি নিষেধ না মেনে ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএ মাজেদ মোটা অংকের বিনিময়ে নিজেই অনুমোদন দিয়েছেন।

পেট্রোবাংলা গঠিত উচ্চ পর‌্যায়ের কমিটি তাদের রিপোর্টে উল্লেখ করেছে, কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বোর্ড সভার অনুমোদন না নিয়ে নিজেই অনুমোদন করেছেন। যা আইনগতভাবে যথাযথ হয় নি।একই প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে আরও একটি জালিয়াতির তথ্য প্রমান পাওয়া গেছে।

তাতে দেখা গেছে কোম্পানিটি মিটার টেম্পারিং করে বিপুল পরিমাণ গ্যাস চুরির ঘটনা ঘটলেও ধামাচাপা দিয়েছেন এমএ মাজেদ সিন্ডিকেট। কোম্পানিটিতে পরীক্ষণ ও মান নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক বিভাগ থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র মার্কেটিং বিভাগকে দিয়ে ত্রুটিপুর্ণ মিটার পর‌্যবেক্ষণ কমিটি গঠনও রহস্যজনক। ব্যবস্থাপনা পরিচালক তার আস্থাভাজনদের রেখেছেন ওই কমিটিতে। যাতে সুবিধামতো রিপোর্ট দিয়ে টুপাইস হাতানো যায়।

৫ কোটি ৫ লাখ ৫৬ হাজার টাকা বকেয়ার কারণে মোস্তফা পেপার কমপ্লেক্সের একটি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। নিয়ম রয়েছে ৫০ শতাংশ বকেয়া পরিশোধ এবং অবশিষ্ট টাকা কিস্তিতে আদায়ের শর্তে পুনঃসংযোগ দিতে পারে ব্যবস্থাপনা পরিচালক। কিন্তু কোন টাকা আদায় না করেই পুনঃসংযোগ প্রদান করেছেন।

মেসার্স ডায়মন্ড সিমেন্ট লিমিটেড (গ্রাহক সংকেত ৮০৬৫) নামের একটি প্রতিষ্ঠানে সংযোগ প্রদানে অভিনব জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়েছে। প্রতিষ্ঠানটি সংযোগের জন্য আবেদন জমা দিলে ২০২০ সালের ২২ নভেম্বর বোর্ডে তুলেছিলেন তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক। সেই বোর্ড সংযোগটি অনুমোদন করেন নি।

এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয় জানার পরও বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই গত বছরের ৫ ডিসেম্বর ডায়মন্ড সিমেন্টকে সংযোগ প্রদান করেছেন এমএ মাজেদ। এতে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের পরিপত্র অমান্য করা হয়েছে বলে তদন্ত কমিটি উল্লেখ করেছে।

বোর্ডের সিদ্ধান্ত জালিয়াতির প্রমান পেয়েছে কমিটি। দেখা গেছে বোর্ডে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়েছে এক রকম, আর কার‌্যপত্রে লেখা হয়েছে ভিন্নভাবে। ২০২১ সালের ২৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ১৭৫তম বোর্ড সভায় ওঠে মেসার্স সায়মা সামিরা টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড (সাদ মুছা গ্রুপ) নতুন সংযোগের আবেদন। পর্ষদের সভার পুর্বেই ওই গ্রাহকের অনুকূলে চাহিদাপত্র ইস্যু করার তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে।

মেসার্স ইয়ং ইন্টারন্যাশনাল (বিডি) লিমিটেড (গ্রাহক সংকেত-৮৫৪) জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। কেজিডিসিএল বোর্ডসভা মাসে ১ লাখ ৭২ হাজার ২২৪ ঘনমিটার লোড অনুমোদন করে। আর সেই ইয়ং ইন্টারন্যাশনালকে প্রায় দ্বিগুণ পরিমাণে (২ লাখ ২৮ হাজার ৭৬৭ ঘনমিটার) লোড বাড়িয়ে দেন দুর্নীতির বরপুত্র খ্যাত এমএ মাজেদ।

কেজিডিসিএল এর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে দুর্নীতির রামরাজত্ব তৈরি করেছেন। সামান্য কিছু উদাহরণ সামনে এলেও আরও পুকুর চুরির ঘটনা থেকে গেছে অন্তরালে। শুধু সংযোগ প্রদানের ক্ষেত্রে জালিয়াতি করে থেমে থাকেনি এম এ মাজেদ।

কোম্পানির সিনিয়র সিলেকশন কমিটির (২০২১ সালের ২১ ও ২২ ডিসেম্বর) সভায় ১৭ পদের বিপরীতে ১৩ জনকে সহকারী ব্যবস্থাপক থেকে উপব্যবস্থাপক পদে পদোন্নতির সুপারিশ দেয়। তারপর সেই পদোন্নতি আটকে রাখেন এম এ মাজেদ। এতে কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা ছড়িয়ে পড়ে।

কেজিডিসিএল’র দুর্নীতির বিষয়ে সর্বশেষ কমিটি গঠন (২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২) করা হয় পরিচালক (পরিকল্পনা) আলী ইকবাল মোঃ নুরুল্লাহ এর নেতৃত্বে। ৪ সদস্যের ওই কমিটি গঠনই করা হয় পরিচালকের (অপারেশন এন্ড মাইন্স) নেতৃত্বে গঠিত কমিটির রিপোর্টের ‍উপর ভিত্তি করে। আলী ইকবাল মোঃ নুরুল্লাহ কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয় আগের কমিটির রিপোর্টের অধিকতর তদন্ত করতে।

আলী ইকবাল মোঃ নুরুল্লাহ কমিটি তদন্তে অসংখ্য অনিয়মের পাশাপাশি কেজিডিসিএল’এ একটি সিন্ডিকেটের প্রমাণ পেয়েছেন। কমিটি তার ৩১ পৃষ্ঠার রিপোর্টে অসংখ্যা দুর্নীতির তথ্য তুলে এনেছেন। কমিটি বলেছে, কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদকে পাশ কাটিয়ে নতুন সংযোগ ও পুনঃসংযোগ প্রদান করা হয়েছে। এতে একদিকে নিয়মকানুন লঙ্ঘিত হয়েছে, অপরদিকে কোম্পানি তথা রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।

তদন্ত কমিটি সুপারিশে ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএ মাজেদ, বিপণন উত্তর ডিভিশনের মহাব্যবস্থাপক (চ.দা) প্রকৌশলী সফিউল আজম খান, বিপণন দক্ষিণ ডিভিশনের মহাব্যবস্থাপক আমিনুর রহমান, জিএম (প্রশাসন) ফিরোজ খানসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে কমিটি।

এ বিষয়ে জানার জন্য ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ মাজেদের সরকারি ফোনে একাধিকবার ফোন দিলেও সংযোগ পাওয়া যায়নি।

সূত্র–বি২৪/এসএস/ফোরকান

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ