শেষ রক্ষা হলো না শরিফ জহিরের


নিজস্ব প্রতিবেদক ১৮ অক্টোবর, ২০২২ ২:১৭ : পূর্বাহ্ণ

মিথ্যা তথ্যে আমদানি করা হয় বিলাসবহুল রোলস রয়েস। শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা যাবে ২০০০ সিসির গাড়ি। কিন্তু আমদানি করা হয়েছে তিনগুণ বেশি ৬৭৫০ সিসির বিলাসবহুল রোলস রয়েস। শুল্কায়ন না করেই অবৈধভাবে নেয়া হয় সিইপিজেডে প্রতিষ্ঠানের কারখানায়। সেখান থেকে আবার অবৈধভাবে অপসারণ করে আনা হয় প্রতিষ্ঠান মালিকের ঢাকার বাসার গ্যারেজে।

কাস্টমস-বন্দরকে না জানিয়ে ব্যবহার করা হয় গাড়িটি। গাড়িতে প্রযোজ্য শুল্ককর প্রায় ২৮ কোটি টাকা ফাঁকি দিতেই লুকোচুরির আশ্রয় নেয় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান। শেষ রক্ষা হয়নি। গ্যারেজ থেকে গাড়িটি আটক করা হয়। ফাঁকি দেয়া শুল্ককরের পাশাপাশি ৫৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড গুনতে হচ্ছে স্বনামধন্য ব্যবসায়ী ও পোশাক খাতের অনন্ত গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরিফ জহিরকে।

সম্প্রতি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস বিচারাদেশ দিয়েছে, যাতে শুল্ককর ফাঁকি প্রমাণিত হওয়ায় এ অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে। তবে, বেপজা অনুমতি দেয়ার পর শর্ত মেনেই গাড়ি আমদানি করা হয়েছে বলে দাবি করেছে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ।

কাস্টমস গোয়েন্দা সূত্রমতে, চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকার (সিইপিজেড) প্রতিষ্ঠান জেড অ্যান্ড জেড ইনটিমেটস লিমিটেড। এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরিফ জহির। তিনি অনন্ত গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক। প্রতিষ্ঠানটি চলতি বছরের ১৫ মার্চ যুক্তরাজ্যের ভারটেক্স অটো লিমিটেড থেকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় একটি রোলস রয়েস আমদানি করে।

আমদানি নথিতে গাড়ির মূল্য দেখানো হয়েছে ২ লাখ ৯৩ হাজার ৭০০ পাউন্ড। ২০২১ মডেলের ৬ হাজার ৭৫০ সিসির কালো রঙের গাড়িটি খালাসের জন্য ২৭ এপ্রিল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এমআই ট্রেড অ্যাসোসিয়েট বিল অব এন্ট্রি দাখিল করে। গাড়িটি ২০১০ সালের আদেশ অনুযায়ী, শুল্কমুক্ত সুবিধায় সিপিসি-১৭০ অনুযায়ী খালাসের জন্য বিল অব এন্ট্রি দাখিল করে। ১১ মে গাড়িটি বন্দর থেকে স্কটিং করে সিইপিজেডে প্রতিষ্ঠানে আনা হয়। প্রতিষ্ঠানের কাঁচামালের সঙ্গে বিশ্বখ্যাত গাড়িটি শুল্কায়ন ছাড়াই খালাস নেয়া হয়েছে।

কাস্টমস গোয়েন্দার মামলার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কাস্টমস গোয়েন্দা গোপন সংবাদ পায়, গাড়ি খালাসের ৭০ দিন পরও শুল্কায়ন করা হয়নি। গাড়িটি শুল্কায়ন ছাড়াই কাস্টমসকে না জানিয়ে ১৭ মে রাতে ঢাকার বারিধারায় প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বাসায় নেয়া হয়েছে। নিবন্ধন প্লেটে ‘অ্যাপ্লাই ফর রেজিস্ট্রেশন’ লিখে গাড়িটি ব্যবহার করা হচ্ছে।

নজরদারির পর ৪ জুলাই ওই ব্যবসায়ীর গাড়ির গ্যারেজ থেকে গাড়িটি জব্দ করে কাস্টমস গোয়েন্দা। আটকের সময় প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ শুল্কায়নের বা গাড়ি খালাসের কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি। সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টকে এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে জানানো হয়, প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ বারবার নিষেধ করার পরও চাপ প্রয়োগ করে গাড়িটি অবৈধভাবে অপসারণ করে ঢাকায় নেয়া হয়। শুল্ককর ফাঁকি দিতেই অবৈধভাবে অপসারণ করে গাড়িটি নেয়া হয়েছে বলে প্রমাণ পেয়েছে কাস্টমস গোয়েন্দা।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গাড়ি খালাসে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ এনবিআরের ২০১০ সালের আদেশ অনুযায়ী সিপিসি-১৭০ সুবিধা দাবি করেছে। কিন্তু আদেশ অনুযায়ী, ইপিজেডের অভ্যন্তরে স্থাপিত শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো কর্তৃক আমদানি করা ২০০০ সিসি পর্যন্ত গাড়ির (কার, পিকআপ, জিপ ও মাইক্রোবাস) ওপর শুল্ককর শর্ত সাপেক্ষে অব্যাহতি পাবে।

কিন্তু আটক করা গাড়ির বনেটে থাকা স্টিকার অনুযায়ী, রোলস রয়েস ৬ হাজার ৭৫০ সিসি। সুবিধাপ্রাপ্তির লিমিট অতিক্রম করায় এটি অব্যাহতির সুবিধা পাবে না। ফলে প্রতিষ্ঠানকে শুল্ককর পরিশোধ করতে হবে। প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মামলার প্রতিবেদন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে পাঠানো হয়। কাস্টম হাউস প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ দাবিনামা সংবলিত কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করে। নোটিশ অনুযায়ী আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ জবাব দাখিল করে ও শুনানিতে অংশ নেয়।

প্রতিষ্ঠান লিখিত জবাবে বলা হয়, ২০০৭ সালে মেসার্স আদি টায়েল (বিডি) লিমিটেড সিইপিজেডে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠানটি নাম পরিবর্তন করে বর্তমান জেড অ্যান্ড জেড ইনটিমেটস লিমিটেডে রূপান্তরিত হয়। জেড অ্যান্ড জেড ইনটিমেটস লিমিটেড ২০১০ সালের এনবিআরের আদেশ অনুযায়ী গাড়িটি খালাসের জন্য বিল অব এন্ট্রি দাখিল করে।

গাড়িটি আমদানিতে ২০২১ সালের ২৬ অক্টোবর বেপজা অনুমতি দেয়। গাড়িটি এসইউভি শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা হয়েছে। এসইউভি গাড়ির ক্ষেত্রে সিসির কোনো শর্ত নেই। গাড়িটি রোলস রয়েস কর্তৃপক্ষের ঢাকাস্থ সার্ভিস সেন্টার মাল্টিব্রান্ড ওয়ার্কশপে সার্ভিসিং করতে নিয়ে আসা হয়েছে। গাড়িটি সরল বিশ্বাসে সার্ভিসিং করতে আনা হয়েছে, শুল্ককর ফাঁকির কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। এরপরও অনুমতি ছাড়া গাড়ি ঢাকায় নেয়ার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা হয়।

সূত্র আরও জানায়, মামলার প্রতিবেদন, প্রতিষ্ঠানের লিখিত জবাব, সিঅ্যান্ডএফের লিখিত জবাব ও শুনানিতে দেয়া বক্তব্য পর্যালোচনা করে কাস্টম হাউস। যাতে বলা হয়, ২০০০ সিসি অতিক্রম করায় এসআরও সুবিধা পাবে না। জেড অ্যান্ড জেড ইনটিমেটস লিমিটেড ২০১৭ সালের ৩০ মার্চ আরজেএসসি নিবন্ধিত হয়েছে।

অর্থাৎ ২০০৯ সালের ২২ মার্চের পর ইপিজেডে নতুন কোনো কোম্পানি শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আমদানি করতে পারবে না। প্রতিষ্ঠান দুইটির ভ্যাট নিবন্ধন, ট্রেড লাইসেন্সের তথ্যে গরমিল রয়েছে। প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, জেড অ্যান্ড জেড ইনটিমেটস এর অনন্ত গ্রুপের শরিফ জহিরের শেয়ার ৯০ শতাংশ, বাকি ১০ শতাংশ ব্রিলিয়ান ওশান ট্রেডিং লিমিটেডের নিরোশ চাকমা।

কিন্তু আইভাস ডেটাবেজ থেকে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানের ২২ দশমিক ৫ শতাংশ শেয়ার শরিফ জহির (ব্যবস্থাপনা পরিচালক), ২২ দশমিক ৫ শতাংশ শেয়ার শওকত আলী চৌধুরী (চেয়ারম্যান), ২২ দশমিক ৫ শতাংশ শেয়ার আসিফ জহির (পরিচালক) ও ১০ শতাংশ শেয়ার ইলেপুরামা আরাচিং (পার্টনার)। প্রতিষ্ঠানের মালিকানা নিয়েও বিভ্রান্তি রয়েছে। সেজন্য শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে না।

পর্যালোচনা আরও বলা হয়, প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শুল্কমুক্ত সুবিধার অপব্যবহার করতে এবং শুল্ককর ফাঁকি দিতেই গাড়িটি অবৈধভাবে অপসারণ করেছে। গাড়িটি দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায় চালানো হয়েছে। শুল্কমুক্ত সুবিধার অপব্যবহার, অবৈধভাবে অপসারণ করায় গাড়িতে প্রযোজ্য শুল্ককর পরিশোধ করতে হবে।

বিলাসবহুল এ গাড়িতে কাস্টমস ডিউটি ২৫ শতাংশ, রেগুলেটরি ডিউটি ৩ শতাংশ, সম্পূরক শুল্ক ৫০০ শতাংশ, ভ্যাট ১৫ শতাংশ, অগ্রিম কর ৫ শতাংশ, আগাম কর ৫ শতাংশ। সে অনুযায়ী এ গাড়িতে প্রযোজ্য শুল্ককর ২৮ কোটি ২৯ লাখ ১৮ হাজার ৭৯৭ টাকা। শুল্ককর ফাঁকি ও অবৈধভাবে গাড়ি অপসারণ করায় কাস্টমস আইন অনুযায়ী গাড়িটি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করার আদেশ দেয়া হয়েছে।

এছাড়া প্রতিষ্ঠানকে ৫৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছে। ফলে প্রতিষ্ঠানকে শুল্ককর ও অর্থদণ্ডসহ মোট ৮৪ কোটি ৮৯ লাখ ১৮ হাজার ৭৯৭ টাকা পরিশোধ করতে হবে। প্রতিষ্ঠানকে এই টাকা পরিশোধে ৩০ দিনের সময় দিয়ে ১২ অক্টোবর বিচারাদেশ দেয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে শরিফ জহিরের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেনি।

সূত্র–এসবি/এসএস/ফোরকান

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ