রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে ক্যাটারিং সার্ভিস ‘চেটেপুটে’ খাচ্ছে সিন্ডিকেট!


মোহাম্মদ ফোরকান  ২৮ জানুয়ারি, ২০২৩ ৬:৪১ : অপরাহ্ণ

বাংলাদেশ রেলওয়ের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই ক্যাটারিং সার্ভিসের ৪ বছরের টেন্ডারের সময় সীমা শেষ হওয়ার পর নতুন করে টেন্ডার আহবান না করে তা আবার আগের ঠিকাদার সিন্ডিকেটের কাছেই নাম মাত্র মূল্যই নবায়ন করেছে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চীফ কর্মাশিয়াল ম্যানেজার নাজমুল ইসলামের (সিসিএম) দপ্তর। এতে বাংলাদেশ রেলওয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।

জানা যায়–বাংলাদেশ রেলওয়ের নিয়ম অনুযায়ী টেন্ডারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আবারও নতুন করে টেন্ডার আহ্বান কর‍তে হয়। কিন্তু রেলওয়ে পুর্বাঞ্চলের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কারণে ক্যাটারিং সার্ভিসে নতুন টেন্ডার আহ্বান না করেই পুরানো ঠিকাদার সিন্ডিকেটের কাছেই নাম মাত্র মূল্য নবায়ন করা হচ্ছে, যা রেল আইনে অবৈধ।

সূত্র জানায়—রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে চলাচলকারী ট্রেনে ক্যাটারিং সার্ভিসের (খাবার সরবরাহ) দায়িত্বে আছে ১৭টি প্রতিষ্ঠান। এরমধ্যে সুবর্ণ এক্সপ্রেস ও রেলভবনের ক্যান্টিনে মেসার্স হাবিব বাণিজ্য বিতান, মহানগর এক্সপ্রেস ও মেঘনা এক্সপ্রেস বিল্লাল ব্রাদার্স এন্ড কোং, মহানগর গোধূলী/তূর্ণায় মেসার্স প্রগতি ক্যাটারার্স, মহানগর প্রভাতী/তূর্ণা এক্সপ্রেস মেসার্স সিরাজ মিয়া রেলওয়ে ক্যাটারার্স, পাহাড়িকা/ উদয়ন এক্সপ্রেসে এস এ করপোরেশন।

যমুনা এক্সপ্রেস/অগ্নিবীণা/এগারসিন্ধুর প্রভাতী/ এগারসিন্ধুর গোধূলী ট্রেনে মেসার্স নিউ টিপটপ ক্যাটারার্স, পারাবত এক্সপ্রেসে মেসার্স ওবায়দুল হক এন্ড সন্স, জয়ন্তীকা/উপবন এক্সপ্রেস মেসার্স আবদুল্লাহ এন্ড কোং, জয়ন্তীকা/উপবন এক্সপ্রেসে মেসার্স আমজাদ এন্ড সন্স, বিজয় এক্সপ্রেসে শরীফ হোটেল রেস্টুরেন্ট এন্ড ক্যাটারার্স।

ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেইল/চট্টলা এক্সপ্রেসে মেসার্স ওয়াহদিকা সার্ভিসেস, হাওর এক্সপ্রেস ও কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেসে মেসার্স শাহান-শাহ ক্যাটারার্স, ব্রহ্মপুত্র এক্সপ্রেসে মেসার্স কে আর ক্যাটারার্স, তিস্তা এক্সপ্রেসে শাহ আমানত এন্টারপ্রাইজ, উপকূল এক্সপ্রেসে মেসার্স সুরুচী ফাস্টফুড, মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে নূর ট্রেডার্স, জামালপুর এক্সপ্রেসেও মেসার্স ওয়াহদিকা সার্ভিসেস খাবার সরবরাহ করে আসছে।

ক্ষতিগ্রস্ত ঠিকাদাররা জানান–গত (২৫ই জানুয়ারি বুধবার) বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) জাহাঙ্গীর হোসেন রেলওয়ে ক্যাটািরিং সার্ভিসের সেই দুর্নিতীবাজ ১৭ ঠিকাদার সিন্ডিকেটদের নিয়ে যাত্রী সেবার মান উন্নয়ন করার বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে উপস্থিত  ছিলেন  দুর্নীতিবাজ ঠিকাদারদের সহায়তাকারী (সিসিএম) বিভাগের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা নাজমুল ইসলামসহ অন্যান্যরা।

জানা যায়, এস এ কপোরেশন, স্বপ্নিল এসোসিয়েশন, জান্নাত ট্রেডিং, প্রগতি রেলওয়ে ক্যাটারস্, শাহা আমানত এক্সপ্রেস, মোরশেদ এন্টারপ্রাইজ, মাহী কনসোটিয়াম, হাবিব বাণিজ্য বিতান, সামির এন্টারপ্রাইজ, ওয়াহদিকা সার্ভিসেসসহ এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিকদের অবৈধ ভাবে বিপুল অর্থের বিনিময়ে বারবার ক্যাটারিং সার্ভিস টেন্ডার বীহিন নবায়ন করে দিচ্ছে রেলওয়ে পুর্বাঞ্চলের কিছু আসাধু কমকর্তা-কর্মচারী। যারা দীর্ঘদিন ধরে সিসিএম দপ্তরে ঘাপটি মেরে রয়েছে।

তথ্য সূত্রে জানা যায়—ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এবং রেলওয়ের আসাধু কমকর্তাদের মাধ্যম হয়ে কাজ করে ওয়াহদিকা সার্ভিসেস স্বর্তাধিকারী ওয়ালিউর রহমান নামের এক ঠিকাদার। তিনি সকল ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের হয়ে মাসিক মাসোহারা আদায় করেন। যা সিসিএম নাজমুল ইসলামসহ এই দপ্তরের অন্যান্য কর্মকর্তা–কর্মচারীরা ভাগবাটোয়ারা করে নেন।

বিষয়টি জানার জন্য ওয়ালিউর রহমানের মুঠোফোনে কল দেয়া হলে তিনি কল রিসিভ করেনি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ঠিকাদার বলেন, প্রতিবার রেলওয়ের ক্যাটারিং সার্ভিসের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে দরখাস্ত আহ্বান করা হতো। এর পর সংশ্লিষ্ট কমিটি যাচাই-বাছাই করে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ক্যাটারিং প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ করে। কিন্তু গত ৪ বছর ধরে পূর্ব রেলে টেন্ডার বিহীন ক্যাটারিং সার্ভিস পরিচালনা করছেন আগের ১৭টি প্রতিষ্ঠান, যাদের লাইসেন্স এর মেয়াদ শেষ হয়েছে ৪ বছর আগে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলের এক যাত্রী বলেন, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সকল ট্রেনের খাবারের মান তেমন ভালো না। আমি শুনেছি এখানে বছরের পর বছর যারা ক্যাটারিং সার্ভিস দেয় তাদের একটি সিন্ডিকেট আছে। তাদের দেয়া খাবারের মান নিম্নমানের সে অনুযায়ী খাবারের দাম আকাশ্চুম্বি। অধিকাংশ খাবারেই থাকে বাসি, অনেক সময় দেখা গেছে অনেক যাত্রী এই বাসি খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এই বিষয় গুলো রেল কর্তৃপক্ষ দেখে না। তারা আছে শুধু ধান্দার তালে।

ক্ষতিগ্রস্ত আরেক ঠিকাদার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন—আমরা বছরের পর বছর ঘুরেও একটি টেন্ডারের কাজ পায় না। সিসিএম দপ্তরের সিন্ডিকেট প্রতিবারই টেন্ডার গুলো মোটা অংকের টাকা ঘুষ দিয়ে নবায়ন করে নিয়ে যাচ্ছে, যা রেল আইন অনুযায়ী সম্পুর্ন বে-আইনী। আমরা ক্ষতিগ্রস্তরা বছরের পর বছর একটি টেন্ডার ও পায় না। আমার মতো আরও অনেক ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান আর্থিক ভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, আবার অনেক ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে।

সাধারণ ঠিকাদাররা আজকের এই পরিনতি ভোগ করছে শুধু সিসিএম নাজমুল ইসলামসহ তার অফিসের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ওয়ালিউর রহমানের মতো ঠিকাদারদের কারণে। এই ওয়ালিউর রহমানেই রেলওয়ের দুর্নীতিগ্রস্থ কর্মকতা এবং অসাধু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান গুলোর মাধ্যমে হিসাবে কাজ করে।

এই বিযয়ে জানতে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের (জিএম) জেনারেল ম্যানেজার জাহাঙ্গীর হোসেন ও (সিসিএম) প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা নাজমুল ইসলামের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তারা উভয়ে কল রিসিভ করেনি।

রেল সংশ্লিষ্টরা জানান, রেলওয়ের এইসব দুনীতিগ্রস্থ কর্মকতা এবং অসাধু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান গুলোর কারণে রেল বিভাগ যেমন বিপুল পরিমাণ অর্থের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে তেমনি হারাচ্ছে যাত্রী সেবার মান। রেলওয়েকে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান থেকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে নিয়ে আসতে হলে অতিবিলম্বে এইসব দুর্নীতিগ্রস্থ কর্মকতা এবং অসাধু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান গুলোর বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যাবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

এসএস

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ