বিষয় :

গার্মেন্টস পণ্য চুরি করে ওরা কোটিপতি!


নিউজ ডেস্ক  ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ৬:৩১ : অপরাহ্ণ

কয়েক বছর ধরে কয়েকটি চক্র গার্মেন্টস পণ্য চুরি করে আসছিল। দীর্ঘদিন ধরে এভাবে গার্মেন্টস পণ্য চুরি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিলেও চক্রের সদস্যরা ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল। অবশেষে শেষ রক্ষা হয়নি। গতকাল ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় র‌্যাবের অভিযানে গ্রেফতার হন চক্রটির চার সদস্য। এরপর তাদের থেকে চুরির এসব তথ্য জানতে পারে র‍্যাব।

শনিবার (৪ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‍্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

র‍্যাব জানায়, ২০২২ সালের ২৯ অক্টোবর কারখানা থেকে কাভার্ডভ্যানে করে পোশাকের একটি চালান ব্রাজিলে রফতানির উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠায় গাজীপুরের কোনাবাড়ির একটি তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। পরদিন ৮৯৮ কার্টুন ভর্তি সোয়েটার চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়। ক্রেতা-মনোনীত শিপিং প্রতিষ্ঠান ১ লাখ ২৫ হাজার ডলারেরও বেশি মূল্যের চালানটি গ্রহণ করে ব্রাজিলে পাঠায় এবং সেই মোতাবেক বন্দর থেকে চালানবহনকারী জাহাজটি রওনা দেওয়ার পরপরই ক্রেতা পুরো অর্থ পরিশোধ করে।

তবে গত ৬ জানুয়ারি ব্রাজিলের ক্রেতার কাছ থেকে পাওয়া ভিডিও দেখে হতবাক হয়ে যান গার্মেন্টস মালিকপক্ষ। সেখানে দেখা যায়, কিছু কার্টুন সম্পূর্ণ খালি এবং অনেকগুলো কার্টুন থেকে প্রচুর পরিমাণ পণ্য খোয়া গেছে। পরবর্তীতে চুরি হওয়া গার্মেন্টস পণ্যের সমপরিমাণ অর্থ জরিমানা হিসেবে পরিশোধ করতে হয় মালিকপক্ষকে।

এ প্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষ গত ২ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের গাছা থানায় ওই চুরির ঘটনায় সাধারণ ডায়েরি করে। যার প্রেক্ষিতে ওই চোর চক্রের সদস্যদের গ্রেফতারসহ ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে র‍্যাব।

এরই ধারাবাহিকতায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে শুক্রবার রাতে মৌলভীবাজার, গোপালগঞ্জ ও ঢাকার আশপাশ এলাকায় পৃথক পৃথক অভিযান চালায় র‍্যাব। এ সময় দেশের গার্মেন্টস পণ্য চুরি কাণ্ডের মূলহোতা শাহেদ ওরফে সাঈদ ওরফে বদ্দা (৫২), মো. ইমারত হোসেন সজল (৩৭), শাহজাহান ওরফে রাসেল ওরফে আরিফ (৩০) ও মো. হৃদয়কে (২৮) গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ব্রাজিলে রপ্তানিকৃত চুরি যাওয়া পণ্যের পরিবহনে ব্যবহৃত একটি কাভার্ড ভ্যান। ওই ঘটনার সাথে গ্রেফতারকৃত চার জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ থেকে র‌্যাব জানতে পারে, গ্রেফতারকৃত শাহেদ ওরফে সাঈদ ওরফে বদ্দা এই গার্মেন্টস পণ্য চুরি জগতের মাস্টারমাইন্ড এবং এই চক্রের মূলহোতা। মূলত তার ছত্রছায়ায় ও সম্মতিতে দেশের প্রায় অধিকাংশ গার্মেন্টস পণ্য চুরির ঘটনা সংঘটিত হয়ে থাকে। ৪০-৫০ জনের এই চক্রে রয়েছে অসাধু ড্রাইভার, হেলপার, গোডাউন মালিক, গোডাউন এলাকার আশ্রয়দাতা, অত্যন্ত দক্ষ কুলি সর্দারসহ একদল লেবার। প্রাথমিক পর্যায়ে তারা ট্রান্সপোর্টে গার্মেন্টসের মালামাল বহন শুরু করে।

একপর্যায়ে তারা গার্মেন্টস পণ্য পরিবহনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কাভার্ডভ্যানের চালক ও সহকারীদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলে এবং অল্প সময়ে বেশি অর্থ লাভের প্রলোভন দেখিয়ে গার্মেন্টস পণ্য চুরির কাজে উৎসাহিত করে। প্রত্যেকটি চুরির পূর্বে গাড়ি চালকদের মাধ্যমে বিদেশে রফতানিকৃত গার্মেন্টস পণ্যের স্যাম্পল নিয়ে চোরাইকৃত পণ্যের সম্ভাব্য বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করত।

চুরির জন্য নির্ধারিত গার্মেন্টস পণ্যের আনুমানিক মূল্য ১২-১৫ লাখ টাকা হলেই তারা চুরি কার্যক্রম পরিচালিত করত। তবে এই মূল্যের কম হলে তারা চুরি করত না। এই টাকা থেকে কাভার্ডভ্যানের চালক ৩০ হাজার, সহকারী ২০ হাজার, গোডাউনের মালিক ৫০ হাজার, গোডাউন এলাকার শেলটার পার্টি ৬০ হাজার, কার্টুন প্যাকেজিং এক্সপার্ট ১০ হাজার, অন্যান্য লেবার প্রত্যেকে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা দেওয়া হত। আর বাকি টাকা তাদের গ্রুপের মধ্যে অবস্থান অনুযায়ী বণ্টন করে নিতো।

চালক ও তার সহকারী পণ্যবাহী কাভার্ডভ্যানটি নির্দিষ্ট গোডাউনে নিয়ে গেলে চক্রের অন্যান্য সদস্যরা কার্টুন কেটে গার্মেন্টস পণ্যগুলো আলাদা করে রাখত। প্রথমত তারা ১০ পিসের কার্টুন থেকে চার পিস এবং ২০ পিসের কার্টুন থেকে ৬-৮ পিস গার্মেন্টস পণ্য সরিয়ে রেখে পুনরায় কার্টুনগুলো প্যাকেজিং করে দ্রুত কাভার্ডভ্যানে লোড করে বন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা দিত।

পরবর্তীতে চক্রের অন্য সদস্যরা চোরাই পণ্যগুলো তাদের নিজস্ব পিকআপ বা কাভার্ডভ্যানের করে অন্য একটি গোডাউনে এক থেকে দেড় মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করত। ট্রান্সপোর্টের মালামাল যখন বিভিন্ন দেশে রফতানির উদ্দেশ্যে বন্দর থেকে দেশের বাইরে চলে যেত তখন তারা চোরাই পণ্যগুলো রাজধানীর উত্তরাসহ বিভিন্ন অসাধু বায়িং হাউজের নিকট বিক্রি করে দিত।

র‍্যাব জানায়, ব্রাজিলে রফতানিকৃত পণ্য চুরির ঘটনাও শাহেদের নির্দেশে সংঘটিত হয়। গত বছর ২৯ অক্টোবর গাজীপুর থেকে গার্মেন্টস পণ্য কাভার্ডভ্যানে লোড করে সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। কাভার্ডভ্যানে পণ্য লোডের পর গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষ চালক শাহজাহানের কাছে নমুনা হিসেবে কিছু সোয়েটার দেয়। চালক শাহজাহান নমুনা পাওয়ার পর ছবি তুলে মোবাইলের মাধ্যমে মূলহোতা শাহেদের কাছে পাঠায়।

শাহেদ নমুনা পেয়ে চুরির ঘটনা বাস্তবায়নকারী আসামি তাওহীদুল ওরফে কাওছার ওরফে বড় কাওছারের কাছে পাঠায় এবং পণ্যের গুনগত মান ও বাজারমূল্য বিবেচনা করে এই চালানটিতে চুরির নির্দেশ দেয়। মাস্টারমাইন্ডের নির্দেশ মোতাবেক কাওছার চালকের সঙ্গে যোগাযোগ করে চুরির মূল প্লট বাস্তবায়ন করে।

পরিকল্পনা অনুযায়ী কাওছারের নির্দেশে চালক ও তার সহকারী ২৯ অক্টোবর মধ্যরাতে ডেমরা থানাধীন মিরপাড়াস্থ আয়েশা প্যাকেজিং ভবনের গোডাউনে কাভার্ডভ্যানটি দাঁড় করিয়ে চুরির ঘটনাটি ঘটায়। আগে থেকে আয়েশা প্যাকেজিং ভবনের গোডাউনে কুলি সর্দার নাজিম, স্থানীয়ভাবে সেল্টারদাতা মাসুম ওরফে মাসুদসহ অজ্ঞাতনামা ৫ থেকে ৭ জন শ্রমিককে নিয়ে মূলহোতা কাওছার অপেক্ষা করে। এরপর প্রত্যেকটি কার্টুন থেকে ৩০-৩৫ শতাংশ পণ্য সরিয়ে পুনরায় প্যাকেজিং করে কাভার্ডভ্যানটি বন্দরের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেয়।

ওই ঘটনায় কার্টুন প্যাকেজিং এ অত্যন্ত দক্ষ কুলি সর্দার নাজিম অন্যান্য লেবারদের নিয়ে কাভার্ড ভ্যান থেকে কার্টুন আনলোড থেকে শুরু করে কার্টুন থেকে পণ্য সরিয়ে পুনরায় প্যাকেজিং এবং কাভার্ড ভ্যানে কার্টুন লোড এর কাজটি করেছে।

র‍্যাব আরও জানায়, গ্রেফতারকৃত শাহেদ চট্টগ্রামে থাকাকালে ১৯৯৬ সালে দুটি ট্রাক ক্রয় করে লোকাল ব্যবসা শুরু করে। ২০০৪ সালে ট্রাক দুটি বিক্রি করে চারটি কাভার্ডভ্যান কিনে গার্মেন্টস পণ্য পরিবহন শুরু করে। সে কাভার্ডভ্যানের চালক ও সহকারীদের প্রলোভন দেখিয়ে তাদের সহায়তায় গার্মেন্টস পণ্য চুরির কার্যক্রমের জন্য একটি সংঘবদ্ধ চোর চক্র তৈরি করে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত সে নিজেই সশরীরে উপস্থিত থেকে চুরির কার্যক্রম চালিয়ে যায়। ২০১৮ সাল পরবর্তী সময়ে সে পর্দার আড়ালে থেকে চুরির কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ শুরু করে এবং প্রত্যেকটি চুরির ঘটনায় আয়কৃত অর্থের সর্বোচ্চ অংশ পেত সে।

মৌলভীবাজার শহরে শাহেদের প্রায় ১৫-২০ কোটি টাকা মূল্যের একটি বাড়ি রয়েছে। মৌলভীবাজারের দূর্লভপুর প্রায় ২০ একর জমির উপরে মাছের খামারসহ বিশাল দুটি হাঁস মুরগির খামারও রয়েছে এবং বর্তমানে তার নিজস্ব চারটি কাভার্ড ভ্যানসহ তার সহযোগীর আরও ১৫টি কাভার্ড ভ্যান রয়েছে বলে জানায়। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ১৭-১৮টি গার্মেন্টস পণ্য চুরির মামলা রয়েছে এবং যার অধিকাংশ মামলায় সে কারাভোগ করেছে বলে জানা যায়। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে আদালতে ছয়টি মামলার বিচারকার্য চলমান রয়েছে।

গ্রেফতারকৃত আসামি ইমারত হোসেন সজল গত ২০১২ সাল থেকে ঢাকার উত্তরায় গার্মেন্টস পণ্যের স্টকলটের ব্যবসা শুরু করে। ব্যবসার সুবাদে গার্মেন্টস পণ্য চুরি জগতের গডফাদার শাহেদ, কাউছারসহ অন্যান্য সদস্যদের সাথে তার পরিচয় হয়। শাহেদের মাধ্যমে কম দামে চোরাইকৃত গার্মেন্টস পণ্য কিনে স্টক করে সুবিধাজনক সময়ে বেশি দামে স্থানীয় মার্কেটসহ বিভিন্নভাবে বিক্রয় করতো।

গত দুই বছরে সে শাহেদের মাধ্যমে ১৫০ থেকে ২০০টি চুরির ঘটনায় চোরাইকৃত গার্মেন্টস পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করেছে। তার এই চোরাইকৃত কিছু কিছু গার্মেন্টস পণ্য বিভিন্ন মাধ্যমে হাত বদল হয়ে বিদেশেও রফতানি হয়েছে। সে অবৈধ পথে কোটি টাকার অধিক স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের মালিক হয়েছে যার মধ্যে গ্রামে ৩০ লক্ষাধিক টাকার একটি বাড়ি ও বিভিন্ন ব্যক্তির নিকট ৩০-৩৫ লাখ টাকার বিনিয়োগ রয়েছে।

গ্রেফতার শাহজাহান ওরফে রাসেল ওরফে আরিফ প্রথমে কাভার্ড ভ্যানের চালকের সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করে। পরবর্তীতে সাত বছর পূর্বে এই চোর চক্রের মাস্টারমাইন্ড শাহেদের নিজস্ব কাভার্ড ভ্যানের চালক হিসেবে কাজ শুরু করে। সেই সুবাদে চালক শাহজাহান চক্রের অন্যতম সদস্য। সে ব্রাজিলে রফতানিকৃত চুরি হওয়া গার্মেন্টস পণ্য বহনকারী কাভার্ড ভ্যানের চালক হিসেবে নিয়োজিত ছিল। বিগত ৬ থেকে ৭ বছরে সে প্রায় শতাধিক চুরির সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে তথ্য প্রদান করে। তার বিরুদ্ধে গার্মেন্টস পণ্য চুরির দুটি মামলা রয়েছে।

গ্রেফতারকৃত হৃদয় চক্রের মাস্টারমাইন্ড শাহেদের নিজস্ব কাভার্ডভ্যান চালকের সহকারী হিসেবে কাজ করত। সে ৬ থেকে ৭ বছর ধরে এই চুরি চক্রের সঙ্গে জড়িত। গার্মেন্টস পণ্য চুরির বহনকারী কাভার্ডভ্যানের চালকের সহকারীর দায়িত্ব পালন করতো সে। বিগত ৬-৭ বছরে প্রায় শতাধিক চুরির সঙ্গে জড়িত হৃদয়। তার বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে একটি মামলা রয়েছে।

এসএস

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ