ফুলকলির প্রতারণা, সোয়া ২৬ কোটি টাকা সরকারের ভ্যাট ফাঁকি


সকালের-সময় রিপোর্ট  ৯ জুলাই, ২০২১ ৩:৫৮ : অপরাহ্ণ

দেশের অভিজাত শ্রেণি ভোক্তাদের ফাস্টফুড, বেকারি আইটেম, মিষ্টি ও স্ন্যাকস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের ফুলকলি। প্রতিষ্ঠানটি তাদের তিনটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২৬ কোটি ২৬ লাখ ৪১ হাজার টাকা সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে, যা সম্প্রতি চট্টগ্রাম কাস্টম, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।

সূত্রে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি তাদের নাসিরাবাদ বায়েজিদ বোস্তামি এলাকার ফুলকলি ব্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড, পূর্ব বাকলিয়ার শাহ্ আমানত ব্রিজ কানেটিং রোড এলাকার ফুলকলি ফুড প্রোডাক্ট লিমিটেড ও পটিয়ার জঙ্গলখাইন নাইখাইন এলাকার মেসার্স ফুলকলি অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডের নামে এসব রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে।

সূত্রে জানায়, চলতি বছর ৩১ মার্চ চট্টগ্রাম কাস্টম, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত একটি নিবারক দল পূর্ব বাকলিয়ার শাহ্ আমানত ব্রিজ কানেটিং রোড এলাকার ফুলকলি ফুড প্রোডাক্ট লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানটি পরিদর্শন করে। প্রতিষ্ঠানটি ফুলকলির মিষ্টি ও স্ন্যাক্স উৎপাদন ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান।

এ সময় নিবারক দল প্রতিষ্ঠানের সঠিক করদায়িতা নিরূপণের জন্য মূসক-১২.৩ মোতাবেক দলিলাদি জব্দ করে। এ জব্দ দলিলপত্রে পরবর্তীকালে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৭ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত ২০টি কর মেয়াদের মাধ্যমে ৮৩ কোটি ২১ লাখ ১৯ হাজার ২০৯ টাকার তাদের উৎপাদিত পণ্য সরবরাহ করে; যার বিপরীতে প্রযোজ্য মূসকের পরিমাণ ১০ কোটি ৮৫ লাখ ৩৭ হাজার ২৮৮ টাকা।

কিন্তু এ সময় প্রতিষ্ঠানটি উক্ত মূসকের বিপরীতে সরকারি রাজস্ব খাতে পরিশোধ করেছে মাত্র দুই কোটি ৯০ লাখ ২৮ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি ওই ২০টি কর মেয়াদের মাধ্যমে সাত কোটি ৯৫ লাখ ৯ হাজার ২৮৭ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে।

এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির সিএ ফার্ম কর্তৃক সম্পাদিত বার্ষিক অডিট রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত যেসব কর যোগ্যসেবা ক্রয় করেছে তার বিপরীতে উৎসে কর দেয়নি। এই তিন অর্থবছরের প্রতিষ্ঠানটি ক্রয় সেবার বিপরীতে এক কোটি ২৩ লাখ ১৫ হাজার ৭৭৮ টাকা রাজস্ব দাঁড়ায়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি ওই টাকার বিপরীতে রাজস্ব আদায় করেছে মাত্র আট লাখ ৪৩ হাজার ৫৭৬ টাকা।

অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি এখানেও এক কোটি ১৪ লাখ ৭২ হাজার ১৯৭ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। তবে সব মিলিয়ে ফুলকলির এ প্রতিষ্ঠানটি ১২ কোটি ৩১ লাখ ৩৪ হাজার ৬৪৫ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। এর মধ্যে ২০১৭ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি ১২৬ কোটি ৩৩ লাখ ১৬ হাজার ৭৯৯ টাকার পণ্য সরবরাহ করে।

এর বিপরীতে প্রদেয় মূসকের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৬ কোটি ৪৭ লাখ ৮০ হাজার ৪৫২ টাকা। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি উক্ত সময়ের মধ্যে পাঁচ কোটি ৩১ লাখ ১৮ হাজার টাকা পরিশোধ করেছে। বাকি ১১ কোটি ১৬ লাখ ৬২ হাজার ৪৪৮ টাকা অপরিশোধিত রয়েছে। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির কাছে ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত এক কোটি ১৪ লাখ ৭২ হাজার ১৯৭ টাকা উৎস কর ফাঁকি দিয়েছে।

এছাড়া তাদের নাসিরাবাদ বায়েজিদ বোস্তামি এলাকার ফুলকলি ব্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠান থেকে ১২ কোটি পাঁচ লাখ ৭০ হাজার ৫৩৩ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। এ প্রতিষ্ঠান ফুলকলি ব্র্যান্ডের বেকারি আইটেম খাদ্যপণ্য উৎপাদন করে।

প্রতিষ্ঠানটি ২০১৬ সালে ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩০৭ কোটি ৬৭ লাখ ২১ হাজার ১৯৩ টাকার খাদ্যপণ্য সরবরাহ করে। এর বিপরীতে ১৪ কোটি ৬৫ লাখ ১০ হাজার ৫৩৩ টাকা মূসক দাঁড়ায়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি এ সময়ের মধ্যে সরকারি কোষাগারে মূসক পরিশোধ করেছে মাত্র দুই কোটি ৫৯ লাখ ৪০ হাজার টাকা। অর্থাৎ ১২ কোটি পাঁচ লাখ ৭০ হাজার ৫৩৩ টাকা বকেয়া রয়েছে।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ফুলকলির জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) আবদুর ছবুর সকালের-সময় ডটকম’কে বলেন, আমাদেরকে ভ্যাট কমিশনারেটের পক্ষ থেকে শোকজ করা হয়েছে, আমরা এই বিষয়ে জবাব দেব, এখানে তো ওরা ভ্যাট ফাঁকির কিছু প্রমান করতে পারেনি, প্রয়োজনে আমরা হাইকোর্টে যাব।

অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানটির পটিয়ার জঙ্গলখাইন নাইখাইন এলাকার মেসার্স ফুলকলি অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত এক কোটি ৮৯ লাখ ৩৬ হাজার ৫৮৫ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। ফুলকলির এ প্রতিষ্ঠানটি ফাস্টফুড ও কেক উৎপাদন ও সরবরাহ করে।

তারা উক্ত সময়ের মধ্যে ২৫ কোটি ৫৯ লাখ ২২ হাজার টাকার পণ্য সরবরাহ করে। এর বিপরীতে মূসকের পরিমাণ দাঁড়ায় তিন কোটি ১৯ লাখ ৪৮ হাজার ৭৪২ টাকা। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি রাজস্ব পরিশোধ করেছে মাত্র এক কোটি ৩০ লাখ ৪৮ হাজার ১৫৭ টাকা।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট উপকমিশনার মো. আহসানউল্লাহ তরুণ বলেন, আমাদের আশঙ্কা ছিল যে ফুলকলি ফুড প্রোডাক্ট তাদের প্রকৃত হিসাব গোপন করছে।

সেই সন্দেহ থেকে আমরা আইন অনুযায়ী তাদের কিছু দলিলপত্র জব্দ করি। তাতে দেখা যায় আমাদের সন্দেহ সঠিক। এতে উক্ত প্রতিষ্ঠানের ২৬ কোটি ২৬ লাখ ৪১ হাজার ৭৬৩ টাকা রাজস্ব ফাঁকি উদ্ঘাটন করতে সামর্থ্য হয়েছি।

সূত্র: এসবি/এসএস/এমএফ

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ