জুয়া সম্রাট থেকে হঠাৎ সমাজসেবী, কে এই মিন্টু ভাই!


সকালের-সময় রিপোর্ট  ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ৭:২০ : অপরাহ্ণ

নাম তার মোঃ আলী আকবর হোসেন চৌধুরী মিন্টু। মানুষের কাছে মিন্টু ভাই নামেই পরিচিত বেশি। হটাৎ করে সমাজসেবী হয়ে ওঠার পিছনের গল্পটা আজ অনেকেরই কাছে প্রশ্ন?

বেশ কয়েক বছর আগেও চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে জন্মগ্রহণ করা আকবরকে তেমন কেউ চিনতো না। হটাৎ তার প্রচারণার পোস্টারিং চকবাজার ১৬ নং ওয়ার্ডের রাস্তার একটি দেয়ালও বাদ পরেনি। মিন্টুর রাতারাতি বিজনেস আইকন ও সমাজসেবী বনে যাওয়ার মূল রহস্য তাহলে কি?

এক সময় ভাড়া বাসায় থাকা এই আলী আকবর হটাৎ জুয়া স্কীম থেকে বনে যায় কোটি কোটি টাকার মালিক। থাকেন কাতালগঞ্জ এলাকায় বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে। চড়েন নামি দামি গাড়িতে। প্রায় গাড়ি বদলানো তার শখ। নতুন নতুন গাড়ি কেনা যেন তার একধরনের নেশা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মিন্টু বিনিয়োগ করেছে দেশে ও বিদেশের বিভিন্ন স্থানে। গ্রাম ও নগরে তার স্ত্রী, স্বজনদের নামে বেশ কিছু দোকান ও জমিতে বিনিয়োগ করার তথ্যও পাওয়া গেছে। এই করোনাকালেই কিনেছেন বেশ কিছু নতুন নতুন জায়গা-জমি।

অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, তার নিজের ও স্ত্রীর নামে রয়েছে বেশ কিছু এফ ডি আর ও সঞ্চয় পত্র। তাছাড়া পরিবারের সদস্য এবং শ্বশুর বাড়ির সদস্যদের নামেও রয়েছে সঞ্চয় পত্র ও এফ ডি আর। আবার চাতুকারীতার সাথে সবকিছুর নমিনী হয়েছে সে নিজেই।

সূত্র জানায়, বিদেশে নিজের জায়গা ও ব্যাবসা তৈরি করে রেখেছেন এই জুয়া সম্রাট আলী আকবর হোসেন চৌধুরী মিন্টু। প্রায় বিদেশ ভ্রমণ যেন তার কাছে দেশের জেলা ভ্রমণের মতই। দেশে—মেন্টেইন করে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, পুলিশ, সাংবাদিক, নেতা ও ক্যাডার সবই। তার সিন্ডিকেট এতই বিশাল যে, কিশোর-তরুন-যুবকদের নিয়ে তার বলয়।

এইসব তরুনদের জন্য সে এক মডেল আইকন। তার প্রতিদিনকার চাল—চলন দেখলে বড় বড় সেলিব্রিটিদের মাথা ঘুরে যাবে, যেন সে বলিউডের বাদশা! জুয়া সম্রাট আলী আকবর এর উত্থান কিভবে? হটাৎ তার সমাজসেবী হয়ে ওটার বিষয়ে খোঁজ নিতে মাঠে নেমেছে দুদকসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

সূত্র মতে, ২০০৮ থেকে ২০১২ পর্যন্ত ইউনিপে টু ইউ, স্পিক এশিয়া, ভিসারেব এইসব লোক ঠকানো বায়বীয় ব্যাবসা দিয়ে তার ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে শুরু করে। অবৈধ এমএলএম ব্যাবসা বা পিড়ামিড স্কিম দিয়ে তার ব্যাবসা শুরু হলেও ধীরে ধীরে বিভিন্নরকম স্কীম ব্যাবসা শুরু করতে থাকেন তিনি।

সাধারণ মানুষের যেখানে লক্ষ টাকা আয় করতে বছরের পর বছর শেষ হয়ে যায়, সেখানে মিন্টু মাত্র কয়েক মাসেই হতে থাকে আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ। এমএলএম ব্যাবসা থেকেই সে পেয়ে যায় কোটি টাকা আয়ের ছক। এইসব অবৈধ ব্যাবসার ছক সাজাতে সে—তৈরি করতে থাকে একটি সংঘবদ্ধ চক্র।

সরকারের নির্দেশে হটাৎ এমএলএম কোম্পানিগুলোর কার্যক্রম ও গতিবিধি পরিলক্ষিত শুরু হলে এই ব্যবসায় নেমে আসে ধস। গ্রাহকদের টাকা ও স্বপ্ন চুরি করে হায় হায় কোম্পানিগুলো বন্ধ হতে থাকে একের পর এক আর তখনই মিন্টু সিন্ডিকেট রঙ বদলে সটকে পরে নতুন ব্যবসার দিয়ে। শুরু করে প্রতারণার নতুন ফাঁদ।

শুরু হয় অনলাইন জুয়া অর্থাৎ আরেকটি দৃশ্যমান প্রতারণা, সেখানেও লেনদেন লক্ষ-কোটি টাকার।
সার্বক্ষণিক বাসায় বসে ব্যস্ত সময় পার করত তিনি। লেনদেন করত লাখ লাখ টাকার। পরিচিতজনদের কাছেও তার সোর্স অব ইনকাম নিয়ে রীতিমতো রহস্য ছিল।

অনলাইনকেন্দ্রিক জুয়ার আসরে চট্টগ্রামের যে কজন নেতৃত্ব দেয় তাদের একজন এই মিন্টু। খেলার জন্য ডলার বিক্রি, জুয়াড়িদের সুদে ঋণদানসহ জুয়ার নানান ক্ষেত্র ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। তার খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন শত শত লোক। মূলত, অনলাইন জুয়ার মূল হোতা সে। শুধু দেশেই নয়, দুবাই, কাতারসহ বিভিন্ন দেশের জুয়াড়িদের একটি বিশাল সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতো এই জুয়া সম্রাট।

“বেট ৩৬৫” ডলার কেনা বেচা এবং তার পাশাপাশি বোনাস হিসেবে আছে বিট কয়েন। এই ডলার কিন্তু ইউএস ডলার নয়, এটা হলো নেটেলার ডলার। সাধারণত ইউএস ডলারের এর চেয়ে এই নেটেলার ডলারের দাম অনেকটা বেশি থাকে। নেটেলার ডলার মূলত জুয়াতে ব্যাবহার করা হয়। যারা অনলাইন জুয়ার সাথে জড়িত তারাই একমাত্র এই বিশেষ প্রকৃতির ডলার চিনে। যা ধরা যায় না, দেখা যায় না শুধু সেই নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে ডিজিট হিসেবে দেখা যায়।

অনলাইন জুয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় সাইড ‘বেট ৩৬৫ এ ক্রিকেট, ফুটবল সহ নিয়ে জুয়া বেট ছাড়াও ছিলো রাওলেট এবং আরও হরেকরকম জুয়া বাজি। পাড়া-মহল্লার ক্লাব ও দোকানের আড্ডায় চলে বাজি ধরার খেলা। ক্রিকেট ও বিভিন্ন অ্যাপভিত্তিক খেলা ভালো বোঝে এমন তরুণরাই এইসব জুয়ার নেশায় পড়েছে বেশি।

দেশি-বিদেশি বিভিন্ন নামে বেটিং সাইট রয়েছে। ওই সাইটগুলোতে প্রথমে অ্যাকাউন্ট খুলে নিবন্ধিত হতে হয়। তারপর নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য কার্ড বা অন্য কোনও মাধ্যমে টাকা জমা দিয়ে জুয়ায় অংশ নিতে হয়। পরে একটি চক্রের মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা নিয়ে তা ডলারে রূপান্তরিত করে জুয়াড়িদের অ্যাকাউন্টে জমা করে। অনলাইন জুয়াড়িরা বিকাশ, রকেট, নগদসহ বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিংয়ে টাকা আদান-প্রদান করে থাকে।

সূত্র মতে, জুয়া খেলে যারা পেমেন্ট ঠিকমতো দিতে পারে না মিন্টু সেক্ষেত্রে তাদের গাড়ি বা মোটরসাইকেল আটকে রাখেন জামানত হিসেবে। অনেকেই ফেরত দিতে পারলে তাদের আমানত নিয়ে যায় আর যারা দিতে পারে না তাদের আমানত বাজেয়াপ্ত হয়ে যায় পরবর্তীতে তা তাদের সিন্ডিকেটের নামে হয়ে যায়। এভাবে মিন্টু মানুষের টাকা একধরনের বায়োবিয় বিষয় দিয়েই নিজের করে নেয়।

একাধিক সূত্র জানায়, ‘বেট-৩৬৫ ডটকম’ নামে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ওয়েবসাইটে সব ধরনের খেলার আপডেটের পাশাপাশি বাজি ধরার প্রস্তাব দেয়া হয়। সেখানেও পড়ে বাজির হিড়িক। ‘বেট৩৬৫ লাইভ’ নামে এসেছে মোবাইল ফোনের অ্যাপ ভার্সন, যেখানে তরুণ-তরুণীরা দেদারছে জুয়া খেলে। আরো কিছু সাইটে গেমিং কেন্দ্রীক অনলাইন জুয়া এখনো—চলছে।

অনলাইনে জুয়া খেলার জনপ্রিয় সাইটগুলোর মধ্যে বেট এশিয়া ৩৬৫, বেটওয়ে ডটকম, বেটফ্রিড ডটকম, ডাফাবেট ডটকম, বেটফেয়ার ডটকম, সাইট ৩৬৫ ডটকম, ৮৮ স্পোর্টস ডটকম, ইউনিবেট ডটকম, বেট ভিক্টর ডটকম, নেটবেট ডটকম, টাইটানবেট ডটকম, উইনার ডটকম ও পেডি পাওয়ার ডটকম বাংলাদেশে—প্রচলিত।

৭০ থেকে ৮০ গুণ লাভের লোভে মানুষ হারিয়েছে তার শেষ সম্বলটুকু অথচ মিন্টুর মত জুয়ারিরা হচ্ছে সেই টাকা দিয়ে তরুন শিল্পপতি বা সমাজসেবী। তারাই পাচ্ছে দেশের স্বনামধন্য ইলেকট্রনিকস মিডিয়া থেকে ডিজিটাল মিডিয়া এওয়ার্ড।

সূত্র জানায়, একসময় ভয়েস বিজনেস বা ভিওয়াইপি ব্যাবসাও নকি করেছিলেন এই আইকন জুয়ারি মিন্টু। ধীরে ধীরে বিনিয়োগ করতে থাকে পরিচিত লোকজনদের রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়। এর মাধ্যমে তার রেস্টুরেন্ট ব্যাবসা শুরু হয়। মাত্র সাত-আট মাস আগে আলী আকবরের “লাইক” রেস্টুরেন্ট এর যাত্রা শুরু হয়। সমগ্র চাটগাঁতে ব্যাপকভাবে সাড়া তোলে এই “লাইক” রেস্টুরেন্ট। এর সাথে আবার শুরু করেন পোশাক ব্যাবসা। তার পোশাকের এই প্রতিষ্ঠানের নাম “ওয়াও লাইফস্টাইল”। দুটি প্রতিষ্ঠানেরই চেয়ারম্যান সে নিজেই।

অনুসন্ধানে বেড়িয়ে আসে, ২০২০ সালে করোনামহামারী যখন চরম পর্যায়ে, ঠিক সেই সময় “চায়না হাউস” নামে একটি স্টোর খুলে বসেন এই আলী আকবর। চওড়া দামে করোনা সামগ্রী বিক্রি করে সেই সময়। করোনার প্রথম ধাক্কায় যেখানে দেশের শত শত মানুষ বেকার হয়ে গেছে সেখানে এই চালাক জুয়ারী কোটি কোটি টাকা আয় করেন।

তাও আবার উচ্চ দামে করোনা সামগ্রী বিক্রয়ে। সেই সময়ে সমগ্র চট্টগ্রামে বিপুলসংখ্যক করোনা সামগ্রী চকবাজার এলাকার “চায়না হাউস” থেকে চওরা দামে বিক্রি হয়েছে বলে জানায় অনেকেই এবং তা নিয়ে অনেক ক্রেতাদের অভিযোগও রয়েছে।

অবশ্য পরবর্তীতে বেশ কিছু পণ্য স্টক হয়ে পরে থাকায় তা থেকে কিছু অংশ পণ্য আলী আকবর বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে বিতরণ করেন সমাজ সেবার নামে। এবং তা আবার ফেসবুকে শেয়ার করেন।

সূত্র আরও জানায়, তার বায়বীয় ব্যবসা ঢাকতে প্রতিষ্ঠা করেন আইসল্যান্ড প্রপার্টিস, এ আর ট্রেডিং, এর আর ট্যুরস এন্ড ট্রাভেলস, ডব্লিউ ও ডব্লিউ ইত্যাদি। এই সকল প্রতিষ্ঠানের আড়ালে চলে তার অদৃশ্যমান বায়বীয় ব্যবসা গুলো।

জানা যায়, জুয়া সম্রাট আলী আকবর মিন্টু বিশাল এক সিন্ডিকেট মেন্টেইন করেন। তার প্রধান সহযোগীর নাম সুমন। সুমন শুধু তার সহযোগীই নয় তার পরম আত্মীয়ও। সুমনের একভাই সাংবাদিক এবং আরেকভাই পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তা। মিন্টু-সুমনের যৌথ পরিচালনায় রয়েছে ইন্টারনেট সংযোগ ও কম্পিউটার-ইলেকট্রনিকস ব্যাবসা।

তরুণ প্রজন্মের কথিত বিজনেস আইকন ও তরুন সামজসেবক আলী আকবর এখন মাঠে কাজ করছেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এর ১৬ নং ওয়ার্ড চকবাজারের কাউন্সিলর নির্বাচনের জন্য। কখনো দেখা যায় শীতবস্ত্র বিতরণে আবার কখনো দেখা যায় খাদ্য-পানীয় বিতরণে। এই সেবামূলক কার্যক্রম কি তার নতুন কোন ধ্রুমজাল কিনা তা জনমনে নতুন করে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে!

সূত্র জানায়, বর্তমানে বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে জুয়া সম্রাট আলী আকবর মিন্টু দুদক ও আয়কর বিভাগের অনুসন্ধানের তালিকাভুক্ত। তবে তদন্তের স্বার্থে তেমন কোন তথ্য বিবরণ জানানো যাচ্ছে না। পরবর্তী প্রতিবেদনে তার ফুলে—ফেপে উঠার রহস্য জানানো হবে ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষায়—থাকুন।

এ বিষয়ে জানার জন্য মোঃ আলী আকবর হোসেন চৌধুরী মিন্টুর ব্যাক্তিগত মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি সকালের-সময় ডট কম’কে বলেন, আমার বিষয়ে আপনি যা শুনেছেন বা জেনেছেন সব মিথ্যা, আমি চকবাজার ১৬ নাম্বার ওয়ার্ড থেকে নির্বাচন করবো বলে মানুষ আমার পিছনে লেগেছে, তারা আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। আর আমি অনলাইন জুয়ার সাথে জড়িত নয়।

সকালের-সময়/এম এফ

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ