ঘুরেফিরে পূর্ব রেলে অনবোর্ড সার্ভিস চষে খাচ্ছে সিন্ডিকেট!


মোহাম্মদ ফোরকান  ১৯ মার্চ, ২০২৩ ৫:৩৮ : অপরাহ্ণ

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে চলাচলকারী বেশিরভাগ ট্রেন সার্ভিস চলছে জোড়াতালিতে। নিম্নমানের সেবা নিয়েই গন্তব্যে পৌঁছছেন যাত্রীরা। বিভিন্ন সময় দাবি উঠলেও লোকসানে বিপর্যস্ত রেলের সেবার মান বাড়াতে অনীহা কর্তৃপক্ষের। তবে–রেল বহরে নতুন কোচ যুক্ত হলেও পুরোনো কোচেই চলে বেশির ভাগ ট্রেন। যাত্রীসেবায় ট্রেনগুলোর মান নিম্নমুখী ও অপরিচ্ছন্ন দেখায় বেশি।

ভেতরের পরিবেশ ভালো থাকার ধারণা নিয়ে ট্রেনে উঠেন যাত্রীরা। তাতেও খারাপ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয় তাদের। সিটে ছাড়পোকা, অপরিচ্ছন্নতায় ভরা থাকে কোচগুলো। সরকার যাত্রীসেবায় গুরুত্ব দিলেও কতিপয় ঠিকাদার ও রেল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদাসীনতায় সেবার মান অত্যন্ত খারাপ। তবে এসব বিষয়ে তেমন কোন নজরদারি নেই দেখভালের দায়িত্বে থাকা (সিসিএম) বাণিজ্যিক দপ্তরের।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে যাত্রীসেবায় অনবোর্ড সার্ভিসের দায়িত্বে আছে ঘুরেফিরে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এখানে ঠিকাদার-কর্মকর্তার সিন্ডিকেট অনবোর্ড নিয়ন্ত্রণ করে। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বাণিজ্যিক বিভাগের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা সিসিএম নাজমুল ইসলাম ও এই দপ্তরের প্রধান সহকারী মোছাম্মদ আরিফা খাতুনের সাথে ঠিকাদারদের সখ্যতা ভালো থাকায় রেল সেবায় নানা অনিয়ম করেও পার পেয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো।

সূত্র জানায়, প্রতিটি ট্রেনের অনবোর্ড থেকে প্রতিমাসে চিফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার (সিসিএম) এর পকেটে ঢুকে কয়েক লক্ষ টাকা। আর এদিকে প্রতিমাসে তার শিষ্য আরিফা খাতুনের টেবিলেও ফেলতে হয় মোটা অংকের টাকা। যার কারণেই রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে অনবোর্ড সার্ভিস পরিচালনার দায়িত্বে থাকে ঘুরেফিরে ৯টি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান যাত্রীসেবার নামে রেলের কাছ থেকে প্রতিমাসে হাতিয়ে নিচ্ছে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা।

সিসিএম দপ্তরের তথ্য সূত্রে জানা যায়–চট্টগ্রাম রুটে সুবর্ণ এক্সপ্রেসে অনবোর্ড পরিচালনা করেন মেসার্স এস এ করপোরেশন, মহানগর গোধুলী/তূর্ণায় স্বপ্নীল এসোসিয়েট, ঢাকা-দেওয়ানগঞ্জ তিস্তা এক্সপ্রেসে জান্নাত ট্রেডিং, ঢাকা-সিলেট পারাবত এক্সপ্রেসে মেসার্স প্রগতি রেলওয়ে ক্যাটারার্স, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহানগর এক্সপ্রেসে শাহ আমানত এন্টারপ্রাইজ, ঢাকা-কিশোরগঞ্জে এগারসিন্ধুর প্রভাতী ও গোধূলীতে মেসার্স সুরুচি ফুড এন্ড ক্যাটারার্স, ঢাকা-সিলেট কালনী এক্সপ্রেসে মেসার্স ওবায়দুল হক এন্ড সন্স….।

আর এদিকে ঢাকা-মোহনগঞ্জ হাওর এক্সপ্রেসে মাহী কনসোর্টিয়াম, মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে সামির এন্টারপ্রাইজ, চট্টগ্রাম-ময়মনসিংহে বিজয় এক্সপ্রেসে শাহ আমানত এন্টারপ্রাইজ, ঢাকা-চট্টগ্রাম সোনার বাংলায় মেসার্স হাবিব বাণিজ্য বিতান অনবোর্ডের দায়িত্বে আছে।

আরও জানা যায়, প্রায় প্রতিষ্ঠানের অনবোর্ড পরিচালনার মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২০ সালে। এর পর থেকে পূর্ব রেলে অনবোর্ডে আর টেন্ডার আহ্বান করা হচ্ছে না। মোটা অংকের ঘুষের বিনিময়ে গোপনে চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়ে দিচ্ছে খোদ (সিসিএম) বাণিজ্য দপ্তরের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

চুক্তি অনুযায়ী—যাত্রা শুরুর আগে ট্রেনে মশা, পোকামাকড় ও দুর্গন্ধ দূর করতে এরোসল ও এয়ার ফ্রেশনার ব্যবহারের শর্ত আছে, সেটিও মানা হয় না ট্রেনগুলোতে। অথচ—বাংলাদেশ রেলওয়ের অনুমোদনপ্রাপ্ত অনবোর্ড সেবা পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রতিটা কোচে স্টুয়ার্ড নিয়োজিত থাকলেও যাত্রীর সহায়তায় এগিয়ে আসতে কখনো দেখা যায়নি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের এক ভুক্তভোগী কর্মকর্তা বলেন, অনবোর্ডের কাজ হচ্ছে যাত্রীসেবা দেয়া। কিন্তু অনবোর্ডের দায়িত্বে যারা আছেন তাদেরকে ট্রেনে উঠতে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। এরপর দীর্ঘযাত্রায় আর কোন কাজে দেখা যায় না তাদের। যাত্রাকালে চোখে পড়বে যাত্রীরা নিজেরাই সিট মুছছে, জানালা খুলতে গলদগর্ম হচ্ছে। অথচ এগুলো যারা অনবোর্ড পরিচালনাকারী ঠিকাদারদের কাজ। অনবোর্ড দিয়ে যাত্রীসেবা বাড়ানোর নামে রেলে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এতে করে রেলের লোকসান এখন আকাশচুম্বী।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যাত্রী সেবার জন্য প্রতিটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে ৪ লাখ ১৮ হাজার ৬০০ টাকা করে পরিশোধ করছে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল। কিন্তু টাকা দেওয়া হলেও সেবা নিশ্চিতে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না রেল কর্তৃপক্ষ। দেখা যায়, মহানগর এক্সপ্রেসসহ প্রায় ট্রেনের কোচে টয়লেটেই সাবান পাওয়া যায়না, বেশ কয়েকটি টয়লেট ছিলো অপরিচ্ছন্ন।

রুবেল বিশ্বাস নামের এক যাত্রী সকালের-সময়কে বলেন, সোনার বাংলাকে দেশের সবচেয়ে ভালো ট্রেন সার্ভিস মনে করা হয়। কিন্তু যাত্রীদের জন্য এই ট্রনের সার্ভিস হাইজেনিক নয়। বিশেষ করে বাথরুমের পরিস্থিতি খুব খারাপ, বেশ অপরিষ্কার ছিলো রুমের ভেতরও।

এছাড়া অনেক সময় চাইলেইও স্টুয়ার্ডদের পাওয়া যায় না। রেলের সঙ্গে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কোচ প্রতি ১ জন স্টুয়ার্ড, ট্রেনে দুইজন সুইপার ও দুইজন সুপারভাইজার নিয়োগ দেবে। যারা টিকিটবিহীন যাত্রী ঠেকাবে এবং যাত্রীদের সেবা নিশ্চিত করবে।

চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, যাত্রী পরিসেবায় ব্যত্যয় ঘটলে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানকে জরিমানার বিধান রয়েছে। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো বছরের পর বছর অনবোর্ড ব্যবসা করলেও সেবা ঘাটতির কারণে কোনো প্রতিষ্ঠানকে রেল কর্তৃপক্ষ জরিমানা করেছে এমন কোনো রেকর্ড নেই।

অনবোর্ড বিষয়ে তথ্য জানতে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সিসিএম দপ্তরের প্রধান সহকারী আরিফা খাতুনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি তথ্য দিতে অপরাগতা প্রকাশ করেন। অনবোর্ডের কোনো তথ্য গণমাধ্যমকে না দিতে সিসিএম স্যার নিষেধ করেছেন মর্মে তিনি প্রতিবেদককে জানিয়েছেন।

এদিকে অনবোর্ড পরিচালনাকারী কয়েকজন ঠিকাদারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা কেউ ফোন রিসিভ করেনি।

তবে অনবোর্ড সার্ভিসের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে জানতে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চীফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার (সিসিএম) নাজমুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনিও ফোন রিসিভ করেনি।

বিষয়টি নিয়ে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) জাহাঙ্গীর হোসেন সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি সকালের-সময়কে জানান, আমরা রেলওয়ের পক্ষ থেকে অনবোর্ড সার্ভিসের জন্য নিয়োগ দিচ্ছি, নিয়োগ হয়ে গেলে ঠিকাদার আর থাকবে না। রেল ভবনের অনুমতি নিয়ে চক্তির শর্তানুযায়ী একটি নির্দিষ্ট পরিমান অংক বাড়িয়ে ঠিকাদারদের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে।

উল্লেখ্য—বাংলাদেশ রেলওয়েতে নতুন বিজয় এক্সপ্রেস ট্রেনে অনবোর্ড সার্ভিস বাতিলসহ বিভিন্ন দাবিতে সম্প্রতি বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সভা করেছে রেলওয়ে শ্রমিক লীগ কেন্দ্রীয় কমিটি। শেষে দাবি সম্বলিত একটি স্মারকলিপি পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপককে দিয়েছিলেন তারা।

এসএস

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ