চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানাধীন আরেফিননগর বাজারে বাইপাস রোডের দক্ষিণ-পশ্চিমে পাহাড় কেটে ২৬ তলা ভবন নির্মাণ করছে স্যানমার প্রপার্টিজ। প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়েছে মহানগর সমিতির সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগের ভিত্তিতে।
প্রকল্পের প্ল্যান দেখিয়ে ২০১৬ সালে প্রতি বর্গফুট কমপক্ষে ৬ হাজার টাকা মূল্যে ফ্ল্যাট বিক্রি শুরু করে স্যানমার প্রপার্টিজ। গ্রাহকদেরও রাখা হয় অন্ধকারে। তবে পাহাড় কাটা নিয়ে স্থানীয়রা আপত্তি তোলার পরই শুরু হয় বিপত্তি। পরিবেশ অধিদপ্তরের নজরে আসে বিষয়টি। এরপর সেখানে অবৈধভাবে পাহাড় কাটার সত্যতা পাওয়া যায়।
বর্তমানে স্যানমার প্রপার্টিজের ‘স্যানমার গ্রিন পার্ক’ শীর্ষক প্রকল্পের স্থানে পাহাড় আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যদিও স্যানমার প্রপার্টিজ এরই মধ্যে প্রকল্পটির বেশির ভাগ ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়েছে। এমনকি এখনো নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রকল্পটিতে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে বিক্রির প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে কোম্পানিটি।
অন্যদিকে গত পাঁচ বছরে এখানে ফ্ল্যাট ক্রয় করা গ্রাহকরা তাদের টাকা ফেরত পেতে ক্রমাগত চাপ দিয়ে যাচ্ছেন স্যানমার কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু বেশ কয়েকবার নোটিস দেয়ার পরও অর্থ ফেরতের বিষয়ে যথাযথ প্রতিশ্রুতি পাননি তারা। অনেক গ্রাহক এখন আইনি পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়েও প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন বলে জানা গেছে।
প্রকল্পটিতে ২০১৬ সালেই দুটি ফ্ল্যাট বুকিং দিয়ে রেখেছিলেন চট্টগ্রামের এক শিল্পপতি। যথানিয়মে কিস্তির পুরো টাকাও পরিশোধ করেছেন তিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, স্যানমার প্রপার্টিজের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী ৩০ জুনের মধ্যে ফ্ল্যাট দুটি হস্তান্তর হওয়ার কথা। এজন্য ৬০ কিস্তিতে পুরো অর্থ পরিশোধও করেছি। প্রকল্পের যে অগ্রগতি তাতে মনে হয় আগামী ছয় বছরেও এটি হস্তান্তর হওয়া সম্ভব নয়। এছাড়া প্রকল্প নিয়েও আইনি ও পরিবেশগত বাধা রয়েছে। দীর্ঘ সময়ের সুনামের কথা বিবেচনা করে স্যানমারের সঙ্গে চুক্তিটি করেছিলাম।
এখন তিক্ত অভিজ্ঞতা হলো। আমি স্যানমার কর্তৃপক্ষকে এরই মধ্যে বেশ কয়েকবার নোটিস করেছি, আমার পরিশোধিত অর্থ পুরো ফেরত দিতে হবে। অন্যথায় চুক্তির মেয়াদ শেষ হলেই এ নিয়ে প্রয়োজনীয় আইনগত পদক্ষেপ নেয়ার কথাও আমি ভেবে রেখেছি।
মহানগর সমিতি এ প্রকল্প নির্মাণস্থলের মালিক মো. জাকিরের কাছে বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রকল্প যেখানে গড়ে উঠছে সেটির ভূমি মালিকানা আমাদের সমিতির। স্যানমার গ্রিন পার্ক প্রকল্পটির কাজ চালিয়ে নিতে কোনো সংস্থার কোনো বাধা নেই। এ বিষয়ে তিনি আর কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, স্যানমার প্রপার্টিজের বিরুদ্ধে পাহাড় কেটে বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণের এটিই একমাত্র অভিযোগ নয়। উত্তর খুলশী থানার ইম্পেরিয়াল হিলের ১০৯/সি নং প্লটের ৪ নম্বর রোডে ছয়তলার অনুমতি নিয়ে ১২ তলা ভবন নির্মাণেরও অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। এ প্রকল্পেও ফ্ল্যাট কেনাবেচা চলমান রয়েছে। সম্প্রতি খুলশীর স্থানীয় ১১ জন বাসিন্দার পক্ষে এ নিয়ে স্যানমারের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন ব্যবসায়ী সাহাবুদ্দিন আলম।
মামলায় অভিযোগ আনা হয়েছে, স্যানমার গ্রানডি নামের উঁচু ভবনটি নির্মাণ করতে গিয়ে এরই মধ্যে প্রায় ৬০ ফুট পাহাড় কেটেছে স্যানমার। ওই স্থানে এখন আর পাহাড়ের চিহ্ন নেই। ভবনটি তৈরি করতে গিয়ে ইমারত নির্মাণ আইন ১৯৫২-এর ১২ ধারা এবং সিডিএ আইন ২০১৮-এর ৪৪ ধারা লঙ্ঘন করা হয়েছে। এছাড়া সেখানে যান চলাচলের জন্য প্রশস্ত কোনো সড়কও নেই। ফলে ভবনটিতে অগ্নিকাণ্ড বা বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষেত্রে উদ্ধার তৎপরতা চালানোও বেশ দুষ্কর হয়ে পড়বে।
এছাড়া নগরীর ষোলশহরে ডানকান হিলের পাদদেশে মাটি কেটে উঁচু ভবন নির্মাণেরও পরিকল্পনা নিয়েছিল স্যানমার। স্থানীয় ২৪ বাসিন্দা পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালকের কাছে স্যানমারের বিরুদ্ধে পাহাড় কাটার অভিযোগ আনার পর বেকায়দায় পড়ে প্রতিষ্ঠানটি। প্রকল্প এলাকায় এরই মধ্যে অসংখ্য গাছ কেটে ফেলার অভিযোগও উঠেছে।
প্রকল্পটির ব্যাপারে সিডিএর বক্তব্য হলো ২০১৩ সালে ডানকান হিলে ২৫ তলা ভবন নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছিল নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। তবে অনুমোদনের তিন বছরেও কাজ শুরু না হওয়ায় সেটি বাতিল হয়ে যায়। পরে আর অনুমোদন দেয়া হয়নি। ডানকান হিল এলাকায় পাহাড় ও গাছ কাটা এবং বহুতল ভবন নির্মাণসংশ্লিষ্ট সব কার্যক্রমের ওপর এপ্রিল পর্যন্ত স্থগিতাদেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। বর্তমানে আদালতের কার্যক্রম শুরু না হওয়ায় সে স্থগিতাদেশ এখনো বহাল রয়েছে।
এ বিষয়ে জানার জন্য স্যানমার প্রপার্টিজের অফিসে ফোন করা হলে কেউও ফোন রিসিভ করেনি। তবে—স্যানমার ছাড়াও নগরীর অন্যান্য আবাসন কোম্পানির বিরুদ্ধে পাহাড় কেটে বহুতল ভবন নির্মাণের অভিযোগ রয়েছে। পরবর্তী প্রতিবেদনে থাকছে তাদের—খবর।
সকালের-সময়/এমএফ