ট্রলারে ১০ মরদেহ–হত্যার মিশনে অংশ নেয় ৫০ মাঝি-মাল্লা


নিউজ ডেস্ক  ২ মে, ২০২৩ ৯:৩৪ : অপরাহ্ণ

জলদস্যু সন্দেহে ১০ জনকে প্রথমে বরফ ভাঙার মুগুর, বাঁশ ও লাঠি দিয়ে পেটানো হয়। পরে এ ঘটনা ধামাচাপা দিতে তাদের কোল্ড স্টোরেজে আটকে রেখে সাগরে বোট ডুবিয়ে দেয়া হয়। আর এ মিশনে অংশ নিয়েছিল ৪টি ট্রলারের অন্তত ৫০ মাঝি-মাল্লা। অবশ্য তার আগে সাগরে ট্রলার লক্ষ্য করে ৩ ঘণ্টা গুলিবর্ষণও হয়েছিল।

মামলায় গ্রেপ্তার ৩ আসামির জবানবন্দির পাশাপাশি স্বজনদের মাধ্যমে বের হয়ে এসেছে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য।

ট্রলারে ১০ জনের মরদেহ উদ্ধার মামলায় আসামি ‘বাইট্টা’ কামাল ও করিম সিকদারকে ৫ দিনের রিমান্ড শেষে আদালতে নেয়া হয়। করিম সিকদার জবানবন্দি না দিলেও রাজি হন বাইট্টা কামাল। সোমবার (১ মে) বিকাল সাড়ে ৪টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে প্রায় ৩ ঘণ্টা জবানবন্দি দেন বাইট্টা কামাল।

আদালত প্রাঙ্গণে বাইট্টা কামালকে দেখার জন্য ছুটে আসে তার পরিবারের সদস্যরা। আর ঘটনার দিন সাগরে কী ঘটেছিল এবং বাইট্টা কামালের সঙ্গে সাগরে ট্রলারে থাকা জেলের সঙ্গে কী কথা হয়েছিল তার বর্ণনা দেন আসামি বাইট্টা কামালের মেয়ে।

বাইট্টা কামালের মেয়ে সুমাইয়া বলেন, ঘটনার দিন আমার চাচা নবী হোসেন ফোন করে বলেছে, আমার আরেক চাচা আনোয়ারের ট্রলার ডাকাতে ধরেছে। তখন বিষয়টি মা জানালে দ্রুত বাবাকে জানানোর জন্য ফোন করি। চাচা আনোয়ারের ট্রলারের জেলেদের ১৫ মিনিট পরপর সাগরে ফেলে দিয়েছে বলে বাবা জানায়। এরপর বাবা অন্যদের সঙ্গে কথা বলেছে।

সুমাইয়া আরও বলেন, ‘ডাকাতরা চাচাদের মারধর করে সাগরে ফেলে দেয়ার পর ট্রলারটি নিয়ে যাচ্ছিল। তখন আরেকটা ট্রলার দেখতে পেয়ে বলেছে, ‘আনোয়ারের ট্রলার নিয়ে যাচ্ছে সবাই আসো’। তারপর ট্রলারে একটা পতাকা টাঙিয়ে দেয়ার পর অনেকগুলো ট্রলার ডাকাতের ট্রলারকে পিছু নেয়। এ সময় ডাকাতরা ৩ ঘণ্টা গুলি চালিয়েছে। গুলিতে একজন জেলে মারা গেছে এবং আরেকজন হাতে গুলিবিদ্ধ হয়েছে, এসব শুনেছি।

এরপর রাগ করে জেলেরা ডাকাতের ট্রলারে উঠে তাদের মারধর করছিল, তখন আমার চাচা অন্য ট্রলার থেকে বলছিল ‘তোমরা ওদেরকে মারধর করিও না, প্রশাসনের কাছে দিয়ে দেব’। কিন্তু চাচা বলেছে, ‘ তুমি কথা বলিও না, তোমাকে একদম কেটে ফেলব’। তখন আমার চাচা আনোয়ার ভয়ে দূরে সরে গেছে। তারপর ওদের মেরে নাকি কোথায় ফেলে দিছে জানে না। এসব বিষয় আমি বাসায় এসে শুনেছি।

ট্রলারে ১০ জনের মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় এ পর্যন্ত ৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এরই মধ্যে গত রোববার (৩০ এপ্রিল) মামলার দুই আসামি ফজল কাদের ও আবু তৈয়ব ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

এই ২ আসামি স্বীকার করেছেন, ৯ এপ্রিল সাগরে একটির ট্রলারকে ঘিরে কয়েকটি ট্রলারের লোকজন ‘ডাকাত-ডাকাত’ বলে মারতে দেখেছেন। যারা মারধর করছিলেন তারা সবাই মহেশখালীর মানুষ। এরা বাঁশখালীর বাসিন্দা। ফলে এই ২ জন ঘটনাস্থল থেকে বাঁশখালী চলে গিয়েছিলেন। আরেক আসামি গিয়াসউদ্দিনের ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।

সোমবার (১ মে) ৫ দিনের রিমান্ড শেষে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন মামলার ১নম্বর আসামি বাইট্টা কামাল। রিমান্ডে বা জবানবন্দিতে কী বলেছে এসব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত জানাতে রাজি হননি তদন্তকারী কর্মকর্তা ও কক্সবাজার সদর থানার পরিদর্শক দুর্জয় বিশ্বাস।

তবে তিনি বলেছেন, জবানবন্দিতে ঘটনায় জড়িত অন্তত ২০ জনের নাম প্রকাশ করেছেন মামলার ১ নম্বর আসামি কামাল। প্রাথমিক বিষয়টি এখনও পরিষ্কার করে বলা যাচ্ছে না। আরও তদন্তের বিষয় আছে, তদন্তের স্বার্থে সবকিছু তো বলা যায় না। নানা বিষয় নিয়ে তদন্ত চলমান রয়েছে।

আর কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি মামলা। এ ঘটনায় যারা ভিকটিম তাদের সংখ্যাও কিন্তু অনেক। সব বিষয়ে পুলিশের যে প্রথাগত পদ্ধতি রয়েছে তা প্রয়োগ করা হচ্ছে। পাশাপাশি প্রযুক্তিভিত্তিক তথ্যও সংগ্রহ করা হচ্ছে। একটি হত্যাকাণ্ডে যত বিষয় জড়িত থাকতে পারে, তার প্রতিটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে।

ট্রলারে ১০ জনের মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় গেল ২৫ এপ্রিল এজাহারভুক্ত ৪ জন এবং অজ্ঞাতনামা আরও ৫০ থেকে ৬০ জনকে আসামি করে মামলা করেন নিহত ট্রলার মালিক শামশুল আলমের স্ত্রী রোকেয়া বেগম।

গত ২৩ এপ্রিল গুরা মিয়া নামে এক ব্যক্তির মালিকানাধীন একটি ট্রলার সাগরে ভাসমান থাকা মরদেহসহ ট্রলারটি উপকূলে নিয়ে আসা হয়। এরইমধ্যে উদ্ধার হওয়া ৬ জনের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করলেও মর্গে রয়েছে ৪ জনের মরদেহ ও একটি কঙ্কাল। ডিএনএ পরীক্ষার পর নিশ্চিত হওয়া যাবে তাদের পরিচয়।

এসএস

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ