চট্টগ্রামে দল গোছাচ্ছে জামায়াত-শিবির, লক্ষ্য ঘাঁটি পুনরুদ্ধার


নিজস্ব প্রতিবেদক ২৯ ডিসেম্বর, ২০২৪ ১০:২৩ : পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামে নিজেদের ঘাঁটি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নেমেছেন দলটির নেতাকর্মীরা। দ্রুত দল গোছাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। সাধারণ মানুষের কাছে দাওয়াত ও সংগঠনের ইতিবাচক দিক তুলে ধরার পাশাপাশি আওয়ামী লীগের আমলে নির্যাতনের চিত্রও জানান দিচ্ছেন বিভিন্ন কর্মসূচিতে। তবে নির্বাচনে সব আসনে প্রার্থী না দেওয়ার ইঙ্গিত নেতাদের থেকে এলেও তা নির্ভর করছে পরিস্থিতির ওপর। এখন রাজনীতির মাঠে ব্যাপকভাবে সক্রিয় তারা।

গত ১৫ বছর জেল-জুলুম, হামলা-মামলাসহ নানা প্রতিকূলতায় রাজনীতির মাঠে কোণঠাসা ছিল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। চট্টগ্রামেও দলটির নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে করা হয় প্রায় দেড়শ মামলা। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রকাশ্যে রাজনীতি করতে পারেনি এই দলটি। তবে মাঠে সক্রিয় না থাকলেও ভেতরে ভেতরে নিজেদের সংগঠনের কাজ ঠিকই চালিয়ে গেছেন তাদের নেতাকর্মীরা। শেষ মুহূর্তে নিষেধাজ্ঞার খড়্গও নেমে আসে দলটির ওপর। তবে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর আবারও মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে জামায়াত।

কর্মী সুসংগঠিত করাসহ হারানো নেতাকর্মীদের ফেরানোর দিকে এখন বেশি নজর তাদের। রয়েছে সাংগঠনিক শৃঙ্খলার বাইরে না যাওয়ার নির্দেশনাও। এরই মধ্যে কার্যক্রম সহজ করতে পাঁচটি করে ওয়ার্ড নিয়ে একটি সাংগঠনিক-প্রশাসনিক রূপ দিয়ে কমিটি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছেন দলটির নেতারা।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগরীর ৪১ ওয়ার্ড ও ১৬টি থানায় জামায়াতে ইসলামীর পূর্ণাঙ্গ কমিটি আছে। এ ছাড়া দলটির ভ্রাতৃপ্রতিম পেশাজীবী সংগঠনের ২১টি কমিটিও আছে নগরীতে। এ ছাড়া দক্ষিণ চট্টগ্রামে চারটি পৌরসভা, তিনটি থানা ও আট উপজেলায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর শাখা কমিটির আমির ঘোষণা করা হয়েছে। নবনির্বাচিত আমিরদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানও হয়েছে।

দল গোছানো, নেতাকর্মীদের হারানো উদ্যম ফিরিয়ে আনা ও সাধারণ মানুষের মধ্যে জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করা যায়—এমন কার্যক্রমের ওপর এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাতে গিয়ে ভিন্ন আদর্শের রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে কোনো ধরনের সংঘাতে না যাওয়ার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে নেতাকর্মীদের প্রতি।

জানা গেছে, দীর্ঘদিন প্রকাশ্যে সাংগঠনিক কার্যক্রম না থাকায় কর্মী-সমর্থকদের বেশিরভাগ এখনো দলীয় নেটওয়ার্কের বাইরে রয়ে গেছে। তাদের সংগঠিত করতে চট্টগ্রাম নগরী ও জেলার তৃণমূল পর্যায়ের সাংগঠনিক স্তরগুলোতে কর্মী সম্মেলন ও কর্মী শিক্ষা শিবির নামে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি করা হচ্ছে। দলের সিনিয়র নেতারা এসব কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে জামায়াতের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অতীতের নেতিবাচক ধারণা দূর করার কৌশলের বিষয়ে কর্মী-সমর্থকদের বিভিন্ন নির্দেশনা দিচ্ছেন। এর মধ্য দিয়ে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সাংগঠনিক পরিধিকে সম্প্রসারণ করে মাঠপর্যায়ে একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি সম্ভব বলে মনে করছেন নীতিনির্ধারকরা।

চট্টগ্রামে জামায়াতের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে বিবেচনা করা হয় চট্টগ্রাম-১৫ (লোহাগাড়া-সাতকানিয়া) আসনটিকে। ওই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন মহানগর জামায়াতের আমির শাহজাহান চৌধুরী। ১৯৯১ সালে এ আসনে তৎকালীন দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুকে হারিয়ে জয়লাভ করেন জামায়াতের প্রভাবশালী নেতা শাহজাহান চৌধুরী।

তবে ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে শাহজাহান চৌধুরীকে হারিয়ে জয় ছিনিয়ে নেন বিএনপির তৎকালীন নেতা ও বর্তমানে এলডিপির সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ। ২০০১ সালে কর্নেল অলিকে হারিয়ে জয় পান শাহজাহান চৌধুরী। এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচনে অলিকে হারিয়ে জেতেন জামায়াতের আরেক প্রভাবশালী নেতা শামসুল ইসলাম। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে সেই আসন দখল করেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবু রেজা মোহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী।

এ ছাড়া চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনেও ভালো সমর্থন রয়েছে জামায়াতের। বাঁশখালী উপজেলা জামায়াতের আমির জহিরুল ইসলাম সেখানে উপজেলা চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ ছাড়া চট্টগ্রাম-৩ (সন্দ্বীপ), চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড), চট্টগ্রাম-১০ (ডবলমুরিং) আসনেও ভালো অবস্থান তৈরির চেষ্টা করে যাচ্ছে দলটি। এ ছাড়া প্রতিটি এলাকায় প্রশাসনের সঙ্গে সুসম্পর্ক সৃষ্টির বিষয়টিও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে জেলা ও থানা পর্যায়ে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সৌজন্য সাক্ষাতের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান জানান দিয়েছেন তারা।

জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ শাহজাহান জানান, ক্ষমতা অপব্যবহারের মাধ্যমে সব বিরোধী দলকে তারা (আওয়ামী লীগ) দমিয়ে রেখেছিল। জামায়াত ছিল তাদের এক নম্বর টার্গেট। তারা চেয়েছিল প্রথমে জামায়াতে ইসলামীকে নেতৃত্ব শূন্য করতে। সেজন্য তারা জুডিশিয়াল কিলিংয়ের পথ বেছে নেয়। এরপর তারা জামায়াতে ইসলামীর গুরুত্বপূর্ণ সব ব্যক্তিকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলায়।

জামায়াতের চট্টগ্রাম মহানগরীর আমির ও সাবেক এমপি শাহজাহান চৌধুরী বলেন, আওয়ামী লীগ মামলার মাধ্যমে আমাদের ব্যস্ত ও নিষ্ক্রিয় রাখতে চেয়েছিল। আমার নামে ৮৫ থেকে ৮৭টি মামলা হয়েছে। প্রায় ছয় বছর আমি জেলে ছিলাম। এতকিছুর পরও আওয়ামী লীগ আমাদের দমাতে পারেনি। আমাদের সাংগঠনিক পদ্ধতির কারণে আমরা সংগঠন ধরে রাখতে পেরেছি।

চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির আ জ ম ওবায়দুল্লাহ জানান, জামায়াতে ইসলামী একটি সুশৃঙ্খল ও সুসংগঠিত দল। শৃঙ্খলা বজায় রেখে আমরা কার্যক্রম পরিচালনা করি। নগরীর ৪১ ওয়ার্ড ও ১৬টি থানায় আমাদের পূর্ণাঙ্গ কমিটি রয়েছে। পেশাজীবীদের ২১টি সংগঠনের কমিটি আছে। সাংগঠনিক কাজ সহজভাবে পরিচালনার জন্য আমরা কয়েকটি ওয়ার্ড মিলে একটি প্রশাসনিক কমিটি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সেটার কার্যক্রম চলছে।

আগামী সংসদ নির্বাচনে নির্দিষ্ট আসনে প্রার্থী দেওয়া হবে জানিয়ে জামায়াতের এ নেতা জানান, সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে আমাদের কাছে সিদ্ধান্ত আছে। আমরা যেখানে প্রার্থী দাঁড় করানোর সেখানে করব। আমাদের সিলেক্ট করা আছে। যখন সুযোগ আসবে তখন যেখানে যাকে প্রয়োজন তাকে মনোনোয়ন দেব। চট্টগ্রাম নগরীতে সব আসনে প্রার্থী হয়তো দেব না। কিছু নির্দিষ্ট আসনে প্রার্থী দেব। তবে সেটা এখন বলা যাচ্ছে না। পরিবেশ বলে দেবে।

এসএস/এমএফ

আরো সংবাদ