বিদ্যুৎ খাতের ক্যাপাসিটি চার্জ

২০ কোম্পানির পকেটে সরকারের ৯০ হাজার কোটি টাকা!


নিজস্ব প্রতিবেদক ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ৯:৩১ : পূর্বাহ্ণ

বেসরকারি খাত থেকে বিদ্যুৎ কিনতে গিয়ে প্রতি বছর মোটা অঙ্কের ক্যাপাসিটি চার্জ গুনছে সরকার। গত ১৫ বছরে এ খাতে রেন্টাল ও আইপিপি (ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) কেন্দ্রগুলোকে দিতে হয়েছে এক লাখ চার হাজার ৯২৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা। ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত এ ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে শীর্ষ ২০টি কোম্পানি বা গ্রুপই পেয়েছে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা।

সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জাতীয় সংসদে জানান, ৮২টি ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার বা আইপিপির মধ্যে ৭০টিকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে। এ বাবদ ব্যয় হয়েছে ৭৬ হাজার ২৪২ কোটি আট লাখ টাকা। আর ৩২টি রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপরীতে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয়েছে ২৮ হাজার ৬৮৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। এ তথ্য বিশ্লেষণ করে দেশি ও বিদেশি কোম্পানি/গ্রুপভিত্তিক ক্যাপাসিটি চার্জের হিসাব তুলে এনেছে শেয়ার বিজ।

১৫ বছরের হিসাব বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত দেড় দশকে ক্যাপাসিটি চার্জ আদায়ে শীর্ষে রয়েছে সামিট গ্রুপ। বর্তমানে গ্রুপটির অধীনে সাতটি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। এছাড়া বিবিয়ানা-২-এর ৮০ শতাংশ ও খুলনা পাওয়ার কোম্পানির ৩৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সামিটের কাছে। সব মিলিয়ে বর্তমানে সামিটের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার ৪৫১ মেগাওয়াট। গত দেড় দশকে গ্রুপটি ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করেছে ১২ হাজার ১৩৪ কোটি ৯৪ লাখ টাকা।

এ তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল। এ কোম্পানিটি দেড় দশক ধরেই বিদ্যুৎ খাতে বাংলাদেশে বড় ধরনের ব্যবসা করে। গত কয়েক বছরে তাদের সবকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র অবসরে চলে গেছে। তবে ১৫ বছরে কোম্পানিটি ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করেছে আট হাজার ৩১০ কোটি ৪১ লাখ টাকা। মালয়েশিয়াভিত্তিক চীনা কোম্পানি এরদা পাওয়ার হোল্ডিংস ক্যাপাসিটি চার্জ আদায়ে রয়েছে তৃতীয় অবস্থানে।

কোম্পানিটির বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বর্তমানে ৮১০ মেগাওয়াট। বর্তমানে এ কোম্পানির দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে বাংলাদেশে। এর একটি মেঘনাঘাটে ৪৫০ মেগাওয়াটের ও অপরটি হরিপুরে ৩৬০ মেগাওয়াটের। কোম্পানিটি গত দেড় দশকে আট হাজার ৩২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করেছে।

দেশীয় ইউনাইটেড গ্রুপ রয়েছে ক্যাপাসিটি চার্জ আদায়ে চতুর্থ অবস্থানে। বর্তমানে এ গ্রুপটির ছয়টি নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। এছাড়া গ্রুপটির কাছে কেপিসিএলের ৩৫ শতাংশ, পায়রায় একটি কেন্দ্রের ৮২ দশমিক ৫০ শতাংশ ও আশুগঞ্জের একটি কেন্দ্রের ৭১ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। সব মিলিয়ে ইউনাইটেড গ্রুপের বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার পাঁচ মেগাওয়াট। দেড় দশকে গ্রুপটি সাত হাজার ৫৭৬ কোটি ৪৭ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করেছে।

বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ বিনিয়োগে নির্মিত পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটির মাত্র তিন বছরেই ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করেছে সাত হাজার ৪৫৫ কোটি ৩১ লাখ টাকা। ক্যাপাসিটি চার্জ আদায়ে পঞ্চম অবস্থানে থাকা এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বাংলাদেশের বর্তমানে সর্ববৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্র। ক্যাপাসিটি চার্জ আদায়ে ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (আরপিসিএল)। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের পাঁচটি সমিতির অধীনে গড়ে ওঠা এ কোম্পানিটির চারটি কেন্দ্র বর্তমানে উৎপাদনে রয়েছে। ১৫ বছরে এ কোম্পানির পকেটে গেছে পাঁচ হাজার ৪৮৭ কোটি ৭৪ লাখ টাকা।

বাংলাক্যাট রয়েছে ক্যাপাসিটি চার্জ আদায়ে সপ্তম স্থানে। এ গ্রুপের পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে বর্তমানে উৎপাদনে রয়েছে অ্যাক্রন ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের (ইউনিট-১, ২ ও ৩), যার উৎপাদন সক্ষমতা ৩০০ মেগাওয়াট। তবে বাংলা ট্র্যাক-১ ও ২ কেন্দ্র দুটি অবসরে চলে গেছে। এ গ্রুপটি দেড় দশকে পাঁচ হাজার ৪২২ কোটি ৯৮ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করেছে।

ক্যাপাসিটি চার্জ আদায়ে অষ্টম অবস্থানে থাকা ওরিয়ন গ্রুপের বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৫০৭ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ১০০ মেগাওয়াটের একটি নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিদ্যুৎকেন্দ্রও রয়েছে। এ গ্রুপটি দেড় দশকে চার হাজার ৮০ কোটি ১৬ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করেছে।

এদিকে নবম স্থানে থাকা পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত খুলনা পাওয়ার কোম্পানির (কেপিসিএল) বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল তিনটি। তবে বর্তমানে দুটি চুক্তিভিত্তিক উৎপাদনে রয়েছে। এছাড়া পায়রায় ইউনাইটেড গ্রুপের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১৭ দশমিক ৫০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে কেপিসিএলের কাছে। সামিট ও ইউনাইটেড গ্রুপের সমান ৩৫ শতাংশ করে ৭০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে কোম্পানিটির। বাকি ৩০ শতাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে রয়েছে। কোম্পানিটি দেড় দশকে ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করেছে তিন হাজার ৭৪৩ কোটি ৬৮ লাখ টাকা।

এ তালিকায় দশম অবস্থানে থাকা হোসাফ গ্রুপের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৮৩ মেগাওয়াট। এনার্জি প্রিমা ও হোসাফ পাওয়ার নামে এ গ্রুপের কেন্দ্রগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। দেড় দশকে এ গ্রুপটি ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করেছে তিন হাজার ৫৪৫ কোটি ৯১ লাখ টাকা।

ক্যাপাসিটি চার্জ আদায়ে এর পর রয়েছে ডরিন গ্রুপ, যারা দেড় দশকে ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করেছে তিন হাজার ৬৬ কোটি ৩১ লাখ টাকা। দুই হাজার ৮৩৩ কোটি ৭৪ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করে ১২তম অবস্থানে আছে মোহাম্মদী গ্রুপ। এর পরের দুটি অবস্থানে রয়েছে সিঙ্গাপুরের সেম্বকর্প ও যুক্তরাষ্ট্রের এপিআর এনার্জি। এ দুই কোম্পানি ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করেছে যথাক্রমে দুই হাজার ৮২৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা ও দুই হাজার ৭৮৮ কোটি চার লাখ টাকা।

দুই হাজার ৩৫৭ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করে ১৫তম স্থানে রয়েছে শাহজীবাজার। ১৬তম স্থানে থাকা ম্যাক্স গ্রুপ দেড় দশকে দুই হাজার ৩৫০ কোটি ৯৪ লাখ টাকা, ১৭তম স্থানে থাকা কনফিডেন্স গ্রুপ দুই হাজার ১৮৪ কোটি ৭১ লাখ টাকা ও ১৮তম স্থানে থাকা বারাকা গ্রুপ পেয়েছে দুই হাজার ১২৭ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।

১৯তম স্থানে থাকা সিকদার গ্রুপ এক হাজার ৮৪২ কোটি ৯১ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করেছে দেড় দশকে। এ সময় শ্রীলঙ্কার অন্যতম বিদ্যুৎ কোম্পানি লক্ষধনভি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস বাংলাদেশ থেকে ক্যাপাসিটি চাজ নিয়ে গেছে এক হাজার ৬৫৮ কোটি আট লাখ টাকা। সব মিলিয়ে ২০টি কোম্পানি/গ্রুপ ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করেছে ৮৯ হাজার ৮২৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকা।

সূত্র—এসবি

সকালের-সময়/এমএফ

Print Friendly, PDF & Email

আরো সংবাদ