১০১ মিলিয়ন ডলার চুরি  

ফেঁসে যাচ্ছেন সাবেক গভর্নর আতিউরসহ ১৪ কর্মকর্তা


নিজস্ব প্রতিবেদক ২৪ জানুয়ারি, ২০২৫ ৯:২৯ : অপরাহ্ণ

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ২০১৬ সালে সাইবার হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে ১০১ মিলিয়ন ডলার চুরির ঘটনায় ফেঁসে যাচ্ছেন সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান। দুদকের প্রাথমিক তদন্তে সাবেক এই গভর্নরসহ ১৪ জনের রিজার্ভ চুরির ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মিলেছে। ফলে দুদকের গোয়েন্দা টিম তাদের নজরদারিতে রেখেছে। দুদক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্র আরও জানায়, ইতিমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) স্ক্রুটিনি সেল একটি তদন্ত নথি প্রস্তুত করে কাজ শুরু করেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছে সংস্থাটি। এমনকি তদন্তের অগ্রগতিও আশানুরূপ। তদন্ত শেষে নথিভুক্ত করে ব্যবস্থা নেবে সংস্থাটি।

এ বিষয়ে দুদকের এক সিনিয়র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রিজার্ভ চুরির ঘটনার মামলাটি হস্তান্তরের জন্য সিআইডিকে গত ১ জানুয়ারি একটি চিঠি দেয় দুদক। পরে তদন্তের কাজ দুদকের কাছে হস্তান্তর বিষয়টি বেশিদূর না এগোলেও সংস্থাটির স্ক্রুটিনি সেল একটি তদন্ত নথি প্রস্তুত করেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত কাজ শুরু করেছে সংস্থাটি।

দুদকের গোয়েন্দা ইউনিট নানা তথ্য সংগ্রহ করেছে। এরই মধ্যে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানসহ ব্যাংকের নেতৃত্বে থাকা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিসহ অন্তত ১৪ জন সাবেক ও বর্তমান সিনিয়র কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ মিলেছে। ফলে তারা ফেঁসে যাচ্ছেন। তাদের গোয়েন্দা নজদারিতে রাখা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, যাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে তাদের মধ্যে আছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান, মেইন্টেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী পরিচালক দীপঙ্কর কুমার চৌধুরী, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ম্যানেজিং ডিরেক্টর আনিস এ খান ওরফে আনিসউদ্দিন আহমদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের অতিরিক্ত পরিচালক এসএম রেজাউল করিম, সাবেক নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা, অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং ডিপার্টমেন্টের (এবিডি) ডিলিং রুমের সহকারী পরিচালক শেখ রিয়াজ উদ্দিন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক (যিনি রিজার্ভ হ্যাকের আলামত নষ্টের দায়ে অভিযুক্ত) ও সাবেক এক ডেপুটি গভর্নরসহ সাত কর্মকর্তা।

দুদকের ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের জন্য ব্যবহৃত সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন (এসডব্লিউআইএফটি) সার্ভার অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি সিস্টেম। এরপরেও সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান রিয়েল টাইম গ্রস সেটেলমেন্ট (আরটিজিএস) সিস্টেম সংযুক্ত করার অনুমোদন দিয়েছিলেন। তাই দুদকের তদন্তকারীরা এটিকে অপরাধ বলে গণ্য করছেন।

জানা যায়, আরটিজিএস এমন একটি ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর মধ্যে তাৎক্ষণিকভাবে অর্থ স্থানান্তর করা সম্ভব হয়। তবে এই রিজার্ভ চুরির ঘটনায় সিআইডির তদন্তের সঙ্গে জড়িত কয়েকজন কর্মকর্তার নাম উঠে এসেছেÑযারা তদন্ত কাজে অসহযোগিতা করেছেন। ফলে যখন এমন ঘটনা ঘটে তখন তদন্তের জন্য দুদকের বিকল্প থাকে না। তাই দুদক তদন্ত করছে। এ ঘটনায় দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের ব্যবহৃত কম্পিউটার বা ল্যাপটপে থাকা তথ্য হ্যাক করার পেছনে সংশ্লিষ্টদের গাফিলতি ছিল।

মূলত রিজার্ভ সরিয়ে ফেলতে একটি নাটক সাজানো হয়। এর সঙ্গে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও জড়িত ছিলেন। এতে মামলাটি নিয়ে সিআইডি কার্যক্রম শুরু করলে তদন্ত প্রতিবেদন পাল্টে দিতে সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানসহ ১৪ কর্মকর্তা তৎপর হন। তাদের নাম বাদ দিতে চাপ দেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। পরে মামলার তদন্ত কার্যক্রম চলে যায় ডিপ ফ্রিজে।

দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) আক্তার হোসেন বলেন, এই মুহূর্তে আমার কাছে তেমন কোনো তথ্য নেই। তদন্ত চলছে। কোনো সিদ্ধান্ত হলে জানানো হবে।

সূত্র জানিয়েছে, ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সুইফট ব্যবস্থা কাজে লাগিয়ে ৩৫টি ভুয়া বার্তার মাধ্যমে ফেডারেল রিজার্ভের নিউইয়র্ক শাখায় বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব থেকে ১০০ কোটি ডলার চুরির চেষ্টা চালায় অপরাধীরা। এর মধ্যে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার লোপাট করতে সক্ষম হয় তারা।

এই অর্থের মধ্যে শ্রীলঙ্কায় যায় ২ কোটি ডলার। সেই অর্থ অবশ্য উদ্ধার করা হয়েছে। তবে বাকি ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার আরসিবিসি ব্যাংক হয়ে ফিলিপাইনের বিভিন্ন ক্যাসিনোয় ঢুকে যায়। চুরি যাওয়া অর্থের মধ্যে এ পর্যন্ত সবমিলিয়ে ৩ কোটি ৪৬ লাখ ডলার উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি ৬ কোটি ৬৪ লাখ ডলার এখনও পাওয়া যায়নি।

এই রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিভাগের কর্মকর্তারা জড়িত থেকে এই নীলনকশা করে। ওই নীলনকশা অনুযায়ী আরটিজিএস নামে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এর সঙ্গে সুইফট প্রক্রিয়ার সংযোগ স্থাপন করলে হ্যাকিংয়ের সূত্রপাত ঘটে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে রিজার্ভ হাতিয়ে নেওয়ার তথ্য ২৪৪ দিন গোপন রাখেন সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান।

পরে ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের উপ-পরিচালক জুবায়ের বিন হুদা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মতিঝিল থানায় মামলা করেন। মামলার তদন্তভার অপরাধী তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) দেওয়া হলেও তারা গত ৯ বছরেও তা শেষ করতে পারেনি। এমনকি তারা আদালতে কোনো প্রতিবেদনও জমা দিতে পারেনি।

তবে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগ করেন। পরে অবশ্য এই রিজার্ভ চুরির মামলার গতি ফেরে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাসহ ১৪ ব্যক্তিকে নজরদারির আওতায় আনা হয়। ইতিমধ্যে গত ১ জানুয়ারি মামলার নথিপত্র চেয়ে সিআইডিকে একটি চিঠি দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন।

অন্যদিকে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪-এর ২০(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘ফৌজদারি কার্যবিধিতে যা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের অধীন ও উহার তপশিলে বর্ণিত অপরাধসমূহ কেবলমাত্র দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক অনুসন্ধানযোগ্য বা তদন্তযোগ্য হইবে।

অবশ্য দুদক বলছে, মামলার এজাহারে যেসব অভিযোগ করা হয়, তা দুর্নীতি দমন কমিশনের তফসিলভুক্ত অপরাধ। দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধ অন্য কোনো সংস্থার তদন্ত করার এখতিয়ার না থাকলেও আইনবহির্ভূতভাবে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডিকে। তাই মামলাটি দুদকের কাছে হস্তান্তর করুক সিআইডি। পরে এ নিয়ে কাজ শুরু করে সংস্থাটি। ইতিমধ্যে দুদকের গোয়েন্দা ইউনিট থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে রিজার্ভ চুরির ঘটনার সুনির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহের কাজ চলমান রেখেছে সংস্থাটি। সংস্থাটির স্ক্রুটিনি সেল একটি তদন্ত নথিপত্র প্রস্তুত করে তদন্ত কাজ শুরু করেছে।

অন্যদিকে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ ক্ষমতা নেওয়ার পর গভর্নর ছিলেন বর্তমান অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। ওই বছরের ৩০ এপ্রিল তার মেয়াদ শেষ হলে নতুন গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পান ড. আতিউর রহমান। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনার পরে তিনি বিদেশে যান।

সূত্র—সময়ের আলো

আরো সংবাদ