

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে লাগাতার আন্দোলন কর্মসূচি চলছে। একটা আন্দোলন শেষ তো আরেকটি আন্দোলন শুরু। অটোরিকশা থেকে অটোপাস, আনসার থেকে পুলিশ। বিসিএস থেকে বিডিআর কিংবা সাত কলেজ পৃথক্করণ থেকে তিতুমীর বিশ্ববিদ্যালয়।
যে যেভাবে পারছে দাবির পসরা নিয়ে বসছে রোজ। পথেঘাটে, সরকারি-বেসরকারি অফিসের সামনে প্রতিনিয়ত আন্দোলন করছে সবাই। ঢাকার রাজপথ যেন দাবি আদায়ের জনপথ। কেউ শুনছে না কারও কথা, আবার আন্দোলনের যৌক্তিক কতটুকু, সেটিও জানে না আন্দোলনকারীরা। সবাই চায় তাদের দাবি আদায়; কিন্তু একবারও কেউ চিন্তা করে না নগরবাসীর ভোগান্তির কথা।
দিনে-রাতে সব সময় দাবি আদায়ের মিছিলে যেন ক্লান্ত ঢাকার রাজপথ। যার তীর্থভূমিতে পরিণত হয়েছে শাহবাগ। তবে এখন মহাখালী, গুলশান, শ্যামলী, মিরপুর, আগারগাঁও, বাড্ডা, রামপুরা, গুলিস্তানসহ সব জায়গায় আন্দোলন চলছে। আবার শুধু যে ঢাকাতেই আন্দোলন হচ্ছে বিষয়টি এমন নয়, দেশের বিভাগীয় ও জেলা-উপজেলাতেও চলছে আন্দোলন, কর্মসূচি ও অবরোধ। যে যেখানে পারছে, সেখানেই বসে পড়ছে, যৌক্তিক-অযৌক্তিক দাবি-দাওয়ার পসরা নিয়ে। যাতে চরমভাবে ভেঙে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। মানুষকে জিম্মি করে পথ-ঘাট বন্ধ করা হলেও তাতে থোড়াই কেয়ার আন্দোলনকারীদের।
শহর জুড়ে দাবি-দাওয়ার বিষয়য়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, জনগণের ভোগান্তি সৃষ্টি করে পথে-ঘাটে অবরোধ দিয়ে যার যে দাবি আছে সেগুলো আদায় করছেন। যারা এত দিন বঞ্চিত ছিলেন, তাদের জন্য সাধারণ মানুষের একটা সমর্থন রয়েছে।
কিন্তু তাদের দাবিটা সঠিক কি না, সেটি আগে বুঝতে হবে। সাধারণ মানুষের ভোগান্তির কথাও চিন্তা করতে হবে। দাবি আদায়ের একপর্যায়ে যদি জনগণের ভোগান্তি চরমে চলে যায়, তাহলে এর ফলও ভালো আসবে না। সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করেই আন্দোলন বা অবরোধ করা উচিত বলে আমি মনে করছি।
সাত কলেজের সমাধান শেষে নগরজীবন যখন একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে প্রস্তুতি নিচ্ছিল, ঠিক তখনই বিশ্ববিদ্যালয়ের আবদার নিয়ে ফের সরব হলেন তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা। মাঝে কদিন হালে পানি না পেলেও এবার চলাচলের পথ অবরোধ করে তারা নেমে পড়লেন আমরণ অনশনে।
একটা কলেজকে হুট করে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করার যথার্থতা এবং বাস্তবতা কতখানি, তা নিয়ে শিক্ষার্থীদের ভাবনাইবা কতখানি? দিনভর সড়ক আটকে আন্দোলন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা পথচারীদের ভোগান্তি। এর শেষ কোথায়, সেই বিষয়ও জানা নেই কারও। তিতুমীর কলেজের কয়েক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কলেজের প্রশাসনের অসহযোগিতা এবং শিক্ষার্থীদের নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার কারণে কলেজের গেট থেকে তারা আজ রাজপথে।
গতকাল রবিবার সন্ধ্যায় এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ওই কলেজের শিক্ষার্থীরা রাজধানীর মহাখালী আমতলী এলাকা ব্লক করে রেখেছেন। এর আগে শিক্ষার্থীরা তাদের কলেজের সামনে আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করেন। মাঝেমধ্যে ঝটিকা মিছিল বের করেন। কখনো গুলশান-১ নম্বর মোড়, কখনো বনানী আবার কখনো ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক আটকে দেন তারা। এতে তীব্র যানজটে পড়তে হয় নগরবাসীর। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে যেখানে ৩০ মিনিট প্রয়োজন, সেখানে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টায়ও পার হতে পারছে না নগরবাসী।
শুধু তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা নন, গতকাল সকাল থেকে রাজধানীর শ্যামলী এলাকায় মিরপুর সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহতরা। তাদের দাবি হলো, ভালো চিকিৎসা, স্থায়ী পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ। আবার রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মদদে জুলাই হত্যাকা-ে জড়িতদের সেফ এক্সিট দেওয়ার প্রতিবাদ ও ব্যর্থতার দায়ে গতকাল বিকেলে ইনকিলাব মঞ্চ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবিতে মিছিল বের করেন।
এর আগে রেলের রানিং স্টাফ আর ইবতেদায়ি শিক্ষকরা মোটামুটিভাবে আন্দোলনের ফসল ঘরে নিয়ে গেছেন। তাই চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্যরাও বসে থাকতে রাজি নন। আওয়ামী লীগ আমলে হারানো চাকরি এখনই ফেরত চাইছেন তারা। এভাবে প্রতিনিয়তই নতুন নতুন আন্দোলনের মধ্যে চরম ভোগান্তিতে কাটছে নগরবাসীর জীবন।
সুচিকিৎসা, পুনর্বাসন ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে গতকাল রাতে দেখা করতে চান জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতরা। এজন্য তারা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু রাজধানীর শাহবাগ এলাকায় ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে তাদের আটকে দেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। পরে আহতরা সেখানেই অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন।
গত শনিবার থেকে বিক্ষোভ করছেন অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিরা। গতকাল রবিবার তারা দিনভর শ্যামলীর শিশুমেলা মোড়ে মিরপুর সড়ক অবরোধ করে রাখেন। সন্ধ্যায় মিরপুর সড়ক ছেড়ে বিক্ষোভরত ব্যক্তিরা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের দিকে যাত্রা করেন। রাত পৌনে ৮টার দিকে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে পৌঁছান তারা। সেখানে পুলিশের ব্যারিকেড দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। একপর্যায়ে ওই জায়গায় বসে বিক্ষোভ শুরু করেন গণঅভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিরা।
পরে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে মধ্যরাতে রাজধানীর মিন্টো রোডে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে পৌঁছান জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিরা। তারা সেখানে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাদের শান্ত করতে মধ্যরাতে সেখানে উপস্থিত হন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ। তিনি বিক্ষোভকারীদের শান্ত করার চেষ্টা করেন। শেষে রাত ২টার দিকে হাসনাত আবদুল্লাহর কাছ থেকে ৭ দিনের মধ্যে দাবি পূরণের আশ্বাস পেয়ে বিক্ষোভকারীরা সেখান থেকে সরে যান।
রাজধানীসহ দেশের কয়েকটি স্থান থেকে প্রায় তিন শতাধিক আহত ব্যক্তিরা এ বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত হিল্লোল।
এ ব্যাপারে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন হিল্লোল জানান, গত শনিবার রাত থেকে তারা সড়কে অবস্থান করলেও সরকারের দায়িত্বশীল কোনো ব্যক্তি তাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেননি এবং ন্যূনতম সহানুভূতিও দেখাননি। অথচ জুলাই আন্দোলনে নিহত ও আহত মানুষদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে এই সরকার ক্ষমতায় এসেছে।
আন্দোলনে এই আহত যোদ্ধা আরও বলেন, গতকাল রবিবার সন্ধ্যায় তারা শিশুমেলা মোড় ছেড়ে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সামনে জড়ো হন। সেখানে যেসব আহত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে নিবন্ধিত, তারা সেই কাগজ নিয়ে পরে একসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার দিকে যাত্রা করেন। এই আহত দেশ রূপান্তরকে আরও জানান, তারা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তাদের দাবি নিয়ে কথা বলতে চান। সেটা না হওয়া পর্যন্ত তারা রাজপথ ছাড়বেন না।
সড়ক অবরোধ না করে, নগরবাসীকে চরম ভোগান্তিতে না ফেলে টেবিল ডিসকাশনের মাধ্যমেও দাবি আদায়ের বিষয়টি সমাধান করা যায় উল্লেখ করে সমাজবিশেষজ্ঞ বলেন, বিগত দিনে গোলটেবিল আলোচনার মাধ্যমে দাবির বিষয়টি সমাধান করার কথা বললেও তা সমাধান হয়নি। তাই সবাই মনে করেন, সড়ক অবরোধ করলেই দাবি আদায় হবে। কিন্তু নগরবাসীর ভোগান্তির কথাও চিন্তা করতে হবে আন্দোলনকারীদের।
নিজেদের সবটা ঢেলে দিয়ে একটি অন্তর্বর্তী সরকারকে দেশের দায়িত্ব দিল যে আপামর ছাত্র-জনতা, সেই তারাই আবার অল্প কদিনের সরকারের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে দাবি-দাওয়ার সীমাহীন বোঝা। এই প্যারাডক্স স্বতঃস্ফূর্ত নাকি ঔদাসীন্য, নাকি আরোপিত, সে প্রশ্নের উত্তর মেলার আগেই হয়তো আগামীকাল দেখা মিলবে নতুন কয়েকটি দাবি-দাওয়ার আন্দোলন।
পেশাজীবী ও সুশীলসমাজ বলছে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই রাজপথে আন্দোলন হচ্ছে। ঘটছে সড়ক অবরোধ, ভাঙচুর, সংঘর্ষ ও হতাহতের ঘটনা। যার প্রভাবে ভোগান্তিতে এরই মধ্যে বিপর্যস্ত, বিরক্ত, ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে ঢাকাবাসী। বিশেষ করে ঘন ঘন অবরোধ, বিক্ষোভ, সংঘর্ষের কারণে গুরুত্বপূর্ণ সব রাস্তা বন্ধ হয়ে পড়ায় তীব্র যানজটে জনভোগান্তি বাড়ছে।
যদিও সরকার বারবার বলছে, যৌক্তিক দাবিতে আন্দোলনের অধিকার সবার রয়েছে। তবে জনগণকে জিম্মি করে যেন আন্দোলন করা না হয়। কিন্তু তাদের আহ্বানে ভ্রুক্ষেপ করছেন না আন্দোলনকারীরা। সবার মধ্যে যেন ধারণা গড়ে উঠেছে, সড়ক অবরোধ করলেই দাবি আদায় সহজ হবে। আর আন্দোলন ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক দল, ছাত্রনেতারা এসব আন্দোলনের পেছনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের উসকানি মনে করছেন।
নগরবাসীর পাশাপাশি সড়কের শৃঙ্খলার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার মো. সরওয়ার বলেন, দাবি আদায়ের আন্দোলনে সবাই সড়ক অবরোধ করে। আর ঢাকায় একটি সড়ক অবরোধ করলে এর প্রভাব পড়ে অলিগলিতেও। যার ফলে শহরের যানজট নিরসনে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের হিমশিম খেতে হয়। দীর্ঘ যানজট সৃষ্টির ফলে নগরবাসীর পাশাপাশি ট্রাফিক পুলিশেরও চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
সূত্র—ডিআর/এসএস/এমএফ