বিষয় :

ডিসি নিয়োগে বিতর্ক তুঙ্গে, জনপ্রশাসনে বিক্ষোভ–হট্টগোল


নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১০:৫৪ : পূর্বাহ্ণ

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মাঠ প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরাতে দলবাজ কর্মকর্তাদের সরিয়ে দক্ষ ও অভিজ্ঞদের পদায়নের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এর অংশ হিসেবে গত সোমবার জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে ২৫ জনকে নিয়োগের পর গতকাল মঙ্গলবার আরও ৩৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু মাঠ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ এ পদটিতে গত দুদিনে নিয়োগ পাওয়া ৫৯ জনের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। ফলে শৃঙ্খলা ফেরাতে নেওয়া উদ্যোগ ঘিরে প্রশাসনে উল্টো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

এদিকে বিগত সরকারের সময়ে নানাভাবে বঞ্চিতরা এবারও ডিসি হতে না পেরে চরম হতাশা ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তারা বিতর্কিতদের নিয়োগ বাতিল করে নতুন নিয়োগের দাবি জানিয়েছেন। বিতর্কিতদের ডিসি করার প্রতিবাদ জানাতে গেলে গতকাল মঙ্গলবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাঠ প্রশাসন অধিশাখার কর্মকর্তা কে এম আলী আজমের কক্ষে দুপক্ষের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছে। হাতাহাতির একটি ভিডিও এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।

এ নিয়ে দিনভর সমালোচনার মুখে নবপদায়নকৃত ডিসিদের নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের ব্রিফিং স্থগিত কথা হয়েছে। সচিবালয় সূত্র জানায়, নতুন ডিসিদের নিয়ে আজ বুধবার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে ব্রিফিং হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু নতুন ডিসিদের নিয়ে সমালোচনা ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে অপ্রীতিকর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল রাতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে একটি জরুরি বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিতব্য ব্রিফিং অনিবার্য কারণবশত স্থগিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত সবাইকে পদায়নকৃত কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে যাত্রা না করে ঢাকায় অবস্থান করতে বলা হয়েছে।

ডিসি নিয়োগে এমন অপ্রীতিকর পরিস্থিতির জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দপ্তরবিহীন উপদেষ্টা সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদারকে দায়ী করেছেন বঞ্চিত একাধিক কর্মকর্তা। তাদের অভিযোগ, আলী ইমাম মজুমদারের পছন্দেই আওয়ামীপন্থি কর্মকর্তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাঠ প্রশাসনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পাচ্ছেন।

এ কাজে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের মহাপরিচালক অতিরিক্ত সচিব আহসান কিবরিয়াও জড়িত। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অত্যন্ত আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিতি রয়েছে আহসানের। এমন কর্মকর্তাদের হাতে প্রশাসন সাজানোর ক্ষমতা দেওয়ায় অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগ প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে বলেও মনে করেন ডিসি নিয়োগে বঞ্চিত কর্মকর্তা।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান বলেন, ডিসি পদে নিয়োগ দেওয়ার আগে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে ফিটলিস্ট তৈরি করা হয়। যাদের পদায়ন করা হয়েছে তাদের মধ্যে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেলে নিয়োগ বাতিল করা হবে। এরই মধ্যে ফেনীতে নুসরাত হত্যাকাণ্ডের সময় তৎকালীন এডিসি পি কে এম এনামুল করিমের ডিসি নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। আমরা যেহেতু এখন অভিযোগ পাচ্ছি নিশ্চয়ই যাচাই-বাছাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।

যাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ

গত দুদিনে ডিসি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া বেশ কয়েকজন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। আবার বিগত সরকারের সময়ে সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধাভোগীরাও ডিসি পদ বাগিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগবঞ্চিত কর্মকর্তাদের। বিতর্কের মুখে এক দিনের মধ্যেই সিলেটের ডিসি হিসেবে এনামুল করিমের নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে।

গত সোমবারের প্রজ্ঞাপনে যেসব কর্মকর্তার নাম রয়েছে, তাদের মধ্যে ফরিদপুরের ডিসি মোহাম্মদ কামরুল হাসান মোল্যা আওয়ামী আমলে ঢাকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা সাভারের ইউএনও ছিলেন। তিনি বর্তমানে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে কর্মরত। বিগত সরকারের আস্থাভাজন হিসেবে তিনি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে কাজ করছেন।

শেরপুরের ডিসি তরফদার মাহমুদুর রহমান সাবেক আইন বিচার ও লেজিসলেটিভ সচিব মইনুল কবিরের একান্ত সচিব (পিএস)। তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ফারহানা ইসলামকে কুষ্টিয়ার ডিসি করা হয়েছে। তিনি নরসিংদী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে থাকার সময় তৎকালীন ডিসি জিল্লার রহমানের ‘ঘনিষ্ঠজন’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর সঙ্গেও তার বন্ধুত্ব রয়েছে। সে সুবাদে তিনি গাজী টেলিভিশনে সংবাদও পাঠ করেন। দীর্ঘদিন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আছেন ফারহানা।

নাটোরের ডিসি রাজীব কুমার সরকার আওয়ামী লীগের কট্টর সমর্থক হিসেবে পরিচিত। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরীর কাছের লোক হিসেবে পরিচিত রাজীব সংস্কৃতি সচিব খলিল আহমেদের পিএস (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ছিলেন।

জয়পুরহাটের ডিসি সাইদুজ্জামান ‘বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্কের’ পিডি ছিলেন। ঢাকায় এসিল্যান্ড থাকাকালে দুর্নীতি মামলায় অভিযুক্ত হয়েছিলেন তিনি। নোয়াখালীর নতুন ডিসি খন্দকার ইশতিয়াক দীর্ঘদিন থেকে মন্ত্রিপরিষদে কর্মরত। তিনি আওয়ামী পরিবারের সদস্য এবং সরাসরি ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

২৪ ব্যাচের কর্মকর্তা চাঁদপুরের ডিসি মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিনকে চলতি বছরের ২৭ মার্চ রংপুরের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার হিসেবে পদায়ন করে আওয়ামী লীগের সরকার। এর পরও তাকে বর্তমান প্রশাসন ডিসি করেছে। এ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।

গতকাল মঙ্গলবার রাজশাহীর ডিসি নিয়োগ পাওয়া মো. মাহবুবুর রহমান ছিলেন সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমদের ঘনিষ্ঠজন। সমাজসেবা অধিদপ্তরের একটি নিয়োগে নিজের পছন্দ অনুযায়ী লোক নিয়োগ দিতে এই মাহবুবুরকে নিয়োগ কমিটির সদস্য করেছিলেন নুরুজ্জামান। এ নিয়ে তখন কালবেলা পত্রিকায় ‘সমাজকল্যাণমন্ত্রীর ইচ্ছা পূরণের ছক’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদনও প্রকাশ হয়েছিল।

মাহবুবুর হাসিনা সরকারের সময়ে ফেসবুকে ‘উই অল আর শেখ হাসিনা’স মেন’ লেখা ফটোকার্ড শেয়ার করেছিলেন। অথচ কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে এভাবে রাজনৈতিক পোস্ট করতে পারেন না। চাকরিবিধিতে তা স্পষ্ট করে নিষেধ আছে। চরম আওয়ামী লীগার হিসেবে পরিচিত মাহবুবুর এখন রাজশাহীর ডিসি। অথচ আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে বঞ্চিতরা ডিসি পদে নিয়োগ পাচ্ছেন না।

এদিকে সমালোচনার মুখে সিলেটের ডিসি নিয়োগ পাওয়া পি কে এম এনামুল করিমের আদেশ বাতিল করেছে সরকার। তার পরিবর্তে সেখানে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের উপসচিব মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

গত সোমবার ডিসি নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারির পর ফেনীর সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) এনামুল করিমের নিয়োগ নিয়ে সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এনামুল করিম ২০১৯ সালে ফেনীর নুসরাত হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্তদের বাঁচাতে সব ধরনের প্রচেষ্টা চালান বলে অভিযোগ রয়েছে। মৃত্যুর আগে নুসরাত জাহান রাফি ও তার মা শিরিন আক্তার ন্যায়বিচারের আশায় তার কাছে গিয়েছিলেন। এরপর এনামুল করিমের বিরুদ্ধে মামলা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অভিযোগ ওঠে।

হতাশ ২৫ ও ২৭ ব্যাচ

বিসিএস ২৫ ও ২৭ ব্যাচের কর্মকর্তারা আশা করেছিলেন তাদের ব্যাচ থেকে আরও বেশি ডিসি নিয়োগ দেওয়া হবে; কিন্তু গত দুদিনের নিয়োগ দেখে তারা চরম হতাশ হয়েছেন। কারণ শুধু ২৪ ব্যাচ থেকেই এখন পর্যন্ত ৭৯ জন ডিসি হয়েছেন। ফলে ২৫ ও ২৭ ব্যাচের বঞ্চিতরা এ নিয়োগকে বৈষম্যমূলক আখ্যা দিয়েছেন। অবিলম্বে বিতর্কিতদের বাদ দিয়ে নতুন করে ডিসি নিয়োগের দাবি তুলেছেন তারা। তাদের একটি অংশ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে গতকাল মাঠ প্রশাসন অধিশাখার কর্মকর্তার কক্ষে গিয়ে হাতাহাতিতেও জড়ান।

প্রজ্ঞাপন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২৪ ব্যাচ থেকে গত সোমবার ১৪ জন এবং গতকাল ১৬ জন ডিসি হয়েছেন। ২৫তম ব্যাচের সর্বমোট ৪৪ জন ডিসি হয়েছেন। গত সোমবার ৭ জন এবং গতকাল হন ১৬ জন। অন্যরা বিগত সরকারের সময়ের নিয়োগ। ২৭ ব্যাচের মাত্র ২৯ জন ডিসি হয়েছেন। গত সোমবার হন ৩ জন। গতকাল হন ৩ জন। বাকিরা এর আগের সরকারের সময়ে নিয়োগ পাওয়া।

সূত্র—কেবি/এসএস/এমএফ

আরো সংবাদ