কম খরচে নিরাপদ ভ্রমণের জন্য পরিচিত বাংলাদেশ রেল। কিন্তু জোবেদা আকতারদের ঘাটে ঘাটে দুর্নীতির কারণে অনেকটাই পঙ্গু হয়ে আছে রেল। রাষ্ট্রীয় এ পরিবহন যাত্রী চাহিদার শীর্ষে থাকা সত্ত্বেও সেবার মান নিয়ে নানা প্রশ্ন যেন লেগেই থাকে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করলে রেলের দুর্নীতির চিত্র ফুঁসে উঠে।
দুদকের একজন পরিচালকের নেতৃত্বে গঠিত টিম রেলওয়ের আইন, বিধি, পরিচালনা পদ্ধতি, সরকারি অর্থ অপচয়ের নানা দিক পর্যবেক্ষণের পর সেগুলো বিশ্লেষণ করে অনিয়মের উৎস শনাক্তসহ দুর্নীতি প্রতিরোধে একটি সুপারিশমালা দিয়েছে রেলমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজনের কাছে।
প্রতিবেদনে দুর্নীতির উৎস হিসেবে বলা হয়, পূর্বাঞ্চল রেলে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি লিজ-হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় অনিয়ম হচ্ছে, রেলওয়ের ওয়াগন, কোচ, লোকোমোটিভ, ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট (ডিএমইউ) ক্রয়ে বড় ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়ম হচ্ছে। বিভিন্ন সেকশন স্টেশনের সিগন্যালিং ব্যবস্থা পুনর্বাসন ও আধুনিকীকরণ কাজে অনিয়ম ও দুর্নীতি হচ্ছে। ডাবল লাইন, সিঙ্গেল লাইন, ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ, ভূমি অধিগ্রহণেও দুর্নীতি হচ্ছে।
চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে বিজি ও এমজি যাত্রীবাহী ক্যারেজ পুনর্বাসন নিলামে যন্ত্রাংশ বিক্রয় প্রক্রিয়ায় ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারের আর্থিক ক্ষতিসাধন করছে সহকারী মহা-ব্যবস্থাপক জোবেদা আক্তারসহ অসাধু কর্মকর্তারা। জোবেদা আক্তার ২০০৮ সালে রেলওয়ে ট্রাফিক বিভাগের ট্রেনিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ পান।
চাকরি জীবনের ১২ বছরের মাথায় নামে-বেনামে হয়েছেন অঢেল সম্পদের মালিক। চট্টগ্রামের বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে রয়েছে তার কাড়ি কাড়ি টাকা। চট্টগ্রাম নগরীর খুলশী এলাকায় রয়েছে বিশাল আলিশান ফ্ল্যাট, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান টিএম ট্রেডার্সে রয়েছে তার ২৫% শেয়ার ও কোটি টাকা মূল্যের চারটি হাইয়েছ গাড়ি। তিনি আবার জারা এপারেলস নামের একটি গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানেরও শেয়ার হোল্ডার বলে জানা যায়।
শুধু তাই নয়, রেলের সকল ঠিকাদারদের সঙ্গে গভির সখ্যতা রয়েছে জোবেদার। এছাড়া ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে হালিশহর রেলওয়ে ট্রেনিং একাডেমিতে এক কোটি টাকার ১২০টি সিসি ক্যামেরা প্রকল্পে নিম্মমানের ক্যামরা লাগিয়ে ঠিকাদারদের যোগসাজশে হাতিয়ে নেন অর্ধ কোটি টাকা। তার বিরুদ্ধে যেন অভিযোগের কমতি নেই। ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি পূর্বাঞ্চল রেলে ৮৬৩ জনকে খালাসী পদে নিয়োগ দিয়ে হাতিয়েছেন মোটা অংকের টাকা।
এ ঘটনায় পূর্বাঞ্চল রেলের সাবেক জিএম, ডজনখানেক কর্মকর্তা, ও রেলের ঠিকাদারের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। এতে করে পূর্বাঞ্চল রেলের সহকারী মহা-ব্যবস্থাপক জোবেদা আক্তারের নামও উঠে আসে দুদকের তদন্তে। এতে জোবেদা আক্তারের অবৈধ নিয়োগ বাণিজ্য ও বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতির তদন্তে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন জেলা সমন্বিত কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ এবং বর্তমানে তদন্ত চলমান।
চলতি বছরের গত ৪ জানুয়ারি জোবেদা আক্তারকে দুর্নীতির ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করেন দুদক জেলা সমন্বিত কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ এর উপ-সহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিন। সেখানে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে বলে প্রতিবেদককে জানান সংশ্লিষ্ট সুত্র।
সূত্রে জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে জোবেদার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আসার পর ২০২০ সালের ৯ জানুয়ারি রেলওয়ের সংস্থাপন শাখার এক আদেশে নগরের হালিশহর ট্রেনিং একাডেমি থেকে সিআরবিতে তাকে বদলি করা হয়। এতে তার শাস্তি হওয়ার পরিবর্তে উল্টো তাকে সহকারী মহা-ব্যবস্থাপক পদে পদোন্নতি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়।
দুদক জেলা সমন্বিত কার্যালয় চট্টগ্রাম-২-এর এক কর্মকর্তা বলেন, খালাসী নিয়োগের ঘটনায় জোবেদা আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। অনেকগুলো বিষয়কে সামনে রেখে তার বিরুদ্ধে অনিয়ম ও অভিযোগের তদন্ত করা হয়েছে। প্রয়োজন হলে তাকে আবারো তলব করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
এ বিষয়ে জানার জন্য পূর্বাঞ্চল রেলের সহকারী মহা-ব্যবস্থাপক জোবেদা আক্তার সাথে সরাসরি অফিসে গিয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি সকালের-সময়কে বলেন, আপনাদের সকল সাংবাদিকের সাথে আমার সু-সম্পর্ক রয়েছে, ওরা এসে আমার অফিসে চা খেয়ে যায়, আমার বিষয়ে অনেকে নিউজ করেছে কিন্তু তারা আমার খুটির জোর সম্পর্কে অবগত হয়ে পরে প্রতিবাদ ও ছাপিয়েছে, আমার নামে নিউজ করে কিছুই করতে পারবেন না, আমার হাত অনেক লম্বা।
এর পর ওনার এক অপকর্মের সহযোগি ফোনে প্রতিবেদককে নিউজ না করার জন্য অনুরোধ করেন। এবং নিউজ করলে মামলা করবে বলে হুমকিও প্রদান করেন।
এ বিষয়ে পূর্ব রেলের (জিএম) জেনারেল ম্যানেজার সর্দার সাহাদাত আলী মোঠোফোনে সকালের-সময়কে বলেন, আপনারা সমাজের দর্পণ, অনিয়ন দুর্নীতি উৎঘাটন করা সাংবাদিকদের দায়িত্ব, দুর্নীতির সকল নিউজ আপনারা গণ-মাধ্যমে তুলে ধরবেন এটাই আমার প্রত্যাশা।
পূর্বাঞ্চল রেলে জোবেদাদের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে সরকার প্রকৃত রাজস্ব হারাচ্ছে। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার জন্য রেলওয়ের জমিতে স্থাপনা নির্মাণ করছে এবং তৃতীয় পক্ষকেও সুযোগ করে দিচ্ছে। আবার তদারকির অভাবে রেল বিভাগের শত শত একর জমি বেদখল হয়ে আছে। রেলের জমিতে সেখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অবৈধভাবে বাসা-বাড়িসহ নানা অবকাঠামো নির্মাণ করে তা ভাড়া দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
জানা যায়, রেলের টিকিট কালোবাজারিতেও স্টেশন ম্যানেজারের সাথেও জোবেদা জড়িত। তারা দালালের মাধ্যমে আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিট আগাম ক্রয় করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। পরে এসব টিকিট গলাকাটা দামে বিক্রি করে। এতে দুর্ভোগ পোহাতে হয় সাধারণ যাত্রীদের। প্রভাবশালীদের কাছে ট্রেন ইজারা প্রদানের মাধ্যমেও যাত্রী হয়রানি করে বলে জানা যায়।
জোবেদা সেন্ডিকেট টিকিটের নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অনেক বাড়তি ধার্য করায় জনসাধারণ কাঙ্খিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে জানান এক উর্ধতন কর্মকর্তা। সর্বোপরি রেলের রাক্ষসদের তদারকি কার্যক্রমের মাধ্যমে সকল দুর্নীতিবাজদের শাস্তির আওতায় আনা প্রয়োজন।
প্রিয় পাঠক..জোবেদা আক্তারসহ রেলের আরো দুর্নীতিবাজদের খবর জানতে আগামী পর্বে চোঁখ রাখুন।