পেশায় সেপিকা দাশ গৃহিণী হলেও তাঁর রয়েছে মাছ চাষের ব্যবসা, করেন কমিশন ব্যবসাও। এসব ব্যবসা পরিচালনা করে মাত্র কয়েক বছরেই সম্পদের পাহাড় গড়েছেন স্ত্রী সেপিকা। অথচ বাস্তবে মাছ চাষ কিংবা কমিশন ব্যবসার মতো কোন কিছুই নেই সেপিকা দাশের। সরকারি চাকুরিজীবী স্বামী মনি লাল দাশের ‘অবৈধ’ আয়েই কোটিপতি বনেছেন তিনি। শুধু স্ত্রী-ই কোটিপতি তা নয়, মনি লাল দাশেরও রয়েছে পৌনে এক কোটি টাকার সম্পদ। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে ওঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য।
মনি লাল দাশ বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) মহাব্যবস্থাপক (অর্থ) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। একইসঙ্গে তিনি দায়িত্বে আছেন সরকারি-বেসরকারি যৌথ মালিকানার স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল লিমিডেটের (এসএওসিএল) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে।
দুদক সূত্র জানায়, ২০২৩ সালে জাল জালিয়াতির মাধ্যমে বিপিসির মহাব্যবস্থাপক মনিলাল দাশ বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ পাওয়ার পর অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। দীর্ঘ অনুসন্ধানে মনিলাল দাশ ও তার স্ত্রী সেপিকা দাশের নামে আড়াই কোটি টাকারও বেশি জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের প্রাথমিক প্রমাণ পায় সংস্থাটি। এ জন্য স্বামী স্ত্রী দুজনের নামে সম্পদ বিবরণী দাখিলের সুপারিশ করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা।
জানা যায়, মনি লাল দাশ ১৯৯৯ সালে সহকারী ব্যবস্থাপক (এমআইএস) হিসেবে বিপিসিতে যোগদান করেন। এরপর ধাপে ধাপে পদোন্নতি পেয়ে বর্তমানে মহাব্যবস্থাপক অর্থ হিসেবে কর্মরত আছেন। পাশাপাশি তিনি এসএওসিএল’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবেও কর্মরত রয়েছেন।
দুদকের অনুসন্ধানে ওঠে আসে, মনি লাল দাশের দায় বাদে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ পাওয়া যায় ৩ কোটি ২৩ লাখ ১৩ হাজার ৮০৪ টাকা। পাশাপাশি তার পারিবারিক ও অন্যান্য ব্যয় হয় ৯৪ লাখ ১০ হাজার ৪০৩ টাকা। সবমিলিয়ে তাঁর ৪ কোটি ১৭ লাখ ২৭ হাজার ২০৭ টাকার সম্পদ অর্জনের তথ্য পাওয়া যায়। এর বিপরীতে তার গ্রহণযোগ্য আয় পাওয়া যায় ৩ কোটি ৪০ লাখ ৯২ হাজার ১৯৩ টাকা। বাকি ৭৬ লাখ ৩৫ হাজার ১৪ টাকার সম্পদ তার জ্ঞাত আয়ের উৎসের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণভাবে অর্জন বলে দুদকে অনুসন্ধানে ওঠে আসে।
অন্যদিকে, মনি লাল দাশের স্ত্রী সেপিকা দাশের পারিবারিক ও অন্যান্য ব্যয়সহ তার মোট অর্জিত সম্পদের পরিমাণ পাওয়ায় যায় ২ কোটি ৪৪ লাখ ৬১ হাজার ৯২৭ টাকার। এর বিপরীতে তার গ্রহণযোগ্য আয় পাওয়া যায় মাত্র ৫৭ লাখ ৪৪ হাজার ৬৭২ টাকা। বাকি ১ কোটি ৮৭ লাখ ১৭ হাজার ২৫৫ টাকা আয়ের উৎস কম পাওয়া যায়। যা তার জ্ঞাত আয়ের উৎসের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণভাবে অর্জন পূর্বক ভোগ দখলে রেখেছেন বলে দুদকের অনুসন্ধানে ওঠে আসে।
স্বামীর অবৈধ আয় বৈধ করতে স্ত্রী বনে যান ব্যবসায়ী
মনি লাল দাশ সরকারি চাকুরিজীবী হলেও তার স্ত্রী সেপিকা দাশ একজন গৃহিণী। কিন্তু তিনি ২০১০-২০১১ করবর্ষ হতে সরকারের একজন নিবন্ধিত করদাতা। সকল সম্পদের হিসেবে তার আয়কর নথিতেও উল্লেখ রয়েছে। তাতে নিজেকে কমিশন ব্যবসা হতে আয়, সঞ্চয়পত্রের সুদ, এফডিআরের সুদ, শেয়ার ব্যবসা ও মৎস্য চাষী হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
তবে দুদকের অনুসন্ধানে বলা হয়, সেপিকা দাশ নিজেকে কমিশন ব্যবসায়ী কিংবা মৎস চাষী হিসেবে উল্লেখ করলেও বাস্তবে তিনি কখনোই কোন প্রকার কমিশন ব্যবসায়ে যুক্ত ছিলেন না। এছাড়া মৎস্য চাষী হিসেবে দাবি করলেও দুদকের কাছে মৎস্য চাষের স্বপক্ষে কোন প্রকার তথ্য প্রমাণ উপস্থাপনও করতে পারেননি। কিংবা এ সংক্রান্ত কোন কাগজপত্রও তিনি দাখিল করতে পারেননি। বরং স্বামীর অবৈধ অর্থ তার নামে আয়কর নথি খুলে বৈধ করার ফন্দি ছিল।
স্বামী-স্ত্রীর সম্পদ বিবরণী দাখিলের সুপারিশ আলোচ্য কর্মকর্তা ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শেষে কমিশনের প্রতিবেদন দাখিল করেছে দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা সহকারী পরিচালক রাজু আহমেদ। প্রতিবেদনে বিস্তারিত উল্লেখের পাশাপাশি স্বামী-স্ত্রী দু’জনের সম্পদ বিবরণী যাচাইয়ের সুপারিশ করা হয়।
দুদক চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়-১ এর উপপরিচালক মো. নাজমুচ্ছায়াদাত বলেন, কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক কর্মকর্তা জানান, সম্প্রতি বিপিসির এ কর্মকর্তা ও তার স্ত্রীর নামে পাওয়া জ্ঞাত আয় বহির্ভূত এসব সম্পদের তালিকাসহ একটি অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। যেখানে আলোচ্য সম্পদগুলোর জন্য পৃথকভাবে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের নামে সম্পদ বিবরণী দাখিলের সুপারিশ করা হয়।
এসএস/ফোরকান