যে কোন মুহুর্তে প্রাণহানির আশংকা..

ফজলুর গ্যাস সিলিন্ডারে ক্রস ফিলিং প্রতারণা, নিরব প্রশাসন!


মোহাম্মদ ফোরকান ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৯ ৮:৪০ : অপরাহ্ণ

চট্টগ্রামে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবসায় আড়ালে চলছে কোটি কোটি টাকার প্রতারণা। হারজারবাগ সরেজমিনে গিয়ে মিলেছে এক ভয়ঙ্কর প্রতারক চক্রের সন্ধান। খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে প্রশাসনিক ক্ষমতা কাটিয়ে দীর্ঘদিন থেকেই চলছে এ লোক ঠকানোর কাজ। আর সে প্রতারণার সাথে জড়িত ফজলুসহ স্থানীয় এক কথিত যুবলীগ নেতা বিলাই সাইফুল।

স্থানীয়দের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে হামজারবাগ গাউসিয়া আবাসিক জুগিপাড়া গলি গ্যাস সিলিন্ডার জালিয়াত চক্রের একটি গোডাউনে গিয়ে দেখি এক অজানা রহস্য। রহস্যঘেরা এ চক্রের মূল হোতা কে তা নিয়ে শুরু হয় নানান প্রশ্ন! তবে সকল প্রশ্নের উত্তর পেতে অনুসন্ধানে বেড়িয়ে আসে প্রতারণার একক নায়ক গ্যাস সিলিন্ডার মাফিয়া ডন চন্দনাইশের ফজলু কাদেরে নাম।

তিনি মুরাদপুর হামজারবাগে গাউছিয়া আবাসিক জুগিপাড়া গলি, কথিত যুবলীগ নেতা বিলাই সাইফুলের ভাড়াটিয়া, সেই ভাড়া ঘরেই সাইুলের ইন্ধনে অবৈধ গ্যাস ‘ক্রস ফিলিং’ করে আসছে সে। বিশেষ করে ফজলুর এই নৈপত্যর কারিগর বিলাই সাইফুল। তার ইন্ধনেই ফজলু কাদের ‘গ্যাস ক্রস ফিলিং’ করে মানুষের সাথে প্রতারণা করে আসছে দীর্ঘদিন।

জানা য়ায়, ফজলু কাদের ক্রস ফিলিং গ্যাস সিলিন্ডার সর্বত্র বিক্রি করেন। তিনি প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি থেকে গ্যাস ভর্তি সিলিন্ডার ক্রয় করে তা এক সিলিন্ডার থেকে গ্যাস সরবরাহ করেন অন্য সিলিন্ডারে। সিলিন্ডারের গায়ে লাগানো হয়, ওমেরা গ্যাস, বিএম গ্যাস নাভানা গ্যাসসহ বিভিন্ন কোম্পানির স্টিকার।

কোন বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ছাড়াই অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে শ্রমিকরা এক সিলিন্ডার থেকে গ্যাস প্রবেশ করান অন্য সিলিন্ডারে। আর সিলিন্ডারপ্রতি লাভ করেন প্রায় ২/৩ শত টাকা। কিন্তু এই সিলিন্ডার বিস্ফোরণে যে হতে পারে বড় ধরণের প্রাণহানি সে তোয়াক্কা করছে না ফজলু। সে এভাবেই গড়ে তুলেছেন তার প্রতারণার সাম্রাজ্য। আর এ সাম্রাজ্যের ইদ্ধনদাতা প্রসাশনের কিছু কতিপয় কর্মকর্তা ও স্থানীয় যুবলীগ নেতা বিলাই সাইফুল ও ফজলুর শালা।

ফজলু ঝুঁকিপূর্ণ পদ্ধতিতে বড় সিলিন্ডার থেকে ছোট সিলিন্ডারে গ্যাস চুরির পাশাপাশি ছোট সিলিন্ডার থেকেও গ্যাস চুরি করে আবার তা খালি সিলিন্ডারে ভরে প্রতারণা করছে। তিনি বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানির সিলিন্ডার কিনে সেগুলো পুনরায় বাজারে ছাড়েন। এবং লাগান ইচ্ছামতো বিভিন্ন কোম্পানির মনোগ্রাম। এতে প্রতিনিয়ত সে গ্রাহকে ঠকাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সুত্র জানায়, ফজলু প্রতিটি বড় ৩৩,৩৪,৩৫ কেজি সিলিন্ডার থেকে গড়ে দুই লিটার গ্যাস চুরি করে দু’শ টাকা বেশি মুনাফা করছে। গাউছিয়া আবাসিক জুগিপাড়া গলির একটি টিন শীটের ঘরে লোকোচুরি করে বিকেল ৪টা থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত রাতের আধারে ক্রস ফিলিংয়ের অবৈধ গ্যাস ব্যবসা করে কোটিপতি বনে গেছেন চন্দনাইশের গাছবাড়িয়ার ফজলু কাদের।

তার এই অবৈধ মরণঘাতী গ্যাস ক্রস ফিলিং যেন দেখছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। বাসাবাড়িসহ ঘনবসতি এলাকা হওয়ায় তার এই অবৈধ গ্যাস ফিলিং যেন এলাকাজুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এলাকায় যে কোন সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে জানান স্থানীয়রা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রতিটি সিলিন্ডারে গড়ে দুই লিটার করে গ্যাস কম দিয়ে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা বেশি মুনাফার লোভে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাধারণ ক্রেতাদের ঠকিয়ে আসছে ফজলু।

সম্প্রতি পটিয়ায় বাবুল মিয়া নামে একজনের গ্যাস সিলিন্ডারের দোকানে অবৈধ ‘ক্রস ফিলিং’র মাধ্যমে এলপি গ্যাস চুরির সময় সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ৫ জন দগ্ধ হবার ঘটনা এখন সবারেই জানা। তার পরও ফজলু প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে অবৈধভাবে ‘গ্যাস ক্রস ফিলিং’র কাজ করে যাচ্ছে।

সূত্র জানায়, ফজলু এলপি গ্যাস চুরি করে ক্রেতা ঠকাচ্ছেন বহুদিন ধরে। তার এ অবৈধ কার্যকলাপের জন্য কিছুদিন আগে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মুরাদ আলী অভিযান চালিয়ে তার এই অবৈধ কারখানা বন্ধসহ তাকে এক মাসের জেল দিয়েছিলো ভ্রাম্যমান আদালত। কিন্তু সেই জেল থেকে বের হয়ে আরো বেপোয়ারা ভাবে গ্যাস ক্রস ফিলিং করছে।

ঝুঁকিপূর্ণ পদ্ধতিতে বড় সিলিন্ডার থেকে ছোট সিলিন্ডারে এবং ছোট সিলিন্ডার থেকে গ্যাস চুরি করে নেয়া হয় খালি সিলিন্ডারে। এ প্রক্রিয়ায় প্রতিটি সিলিন্ডারে গড়ে দুই লিটার করে গ্যাস কম দেয়া হয়। ফজলু ক্রেতাদের ঠকিয়ে এভাবে গড়ে দু’শ টাকার বেশি মুনাফা করে প্রতারণা করছে বলে জানা যায়।

মুরাদপুরের এক গ্যাস ব্যবসায়ী সকালের-সময়কে বলেন, ছোট সিলিন্ডারগুলোতে কোম্পানিভেদে ১২ কেজি গ্যাস থাকার কথা। খুচরা পর্যায়ে গ্যাসের সিলিন্ডার ওজন করে বিক্রি করা হয় না। সাধারণ ক্রেতারা বিশ্বাস করে সিলিন্ডার কিনে নেন। যখন গ্যাস নির্ধারিত সময়ের আগে শেষ হয়ে যায় তখনই খুচরা গ্রাহকরা বুঝতে পারেন তারা ঠকেছেন। এতে আমাদের মত খুচরা ব্যবসায়ীদের দুর্নাম হচ্ছে। আপনারা জানেন কিনা জানিনা! ক্রস ফিলিংয়ের অবৈধ ব্যবসা এখন চট্টগ্রামে জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে এটা খুবেই ভয়বহ আকার ধারণ করছে।

সুত্র জানায়, ফজলু কাদের এলপি গ্যাসের ওমেরা ৩৫, ৩৫, ৪৫ কেজি সিলিন্ডার থেকে ছোট সিলিন্ডারে রেগুলেটর দিয়ে গ্যাস স্থানান্তর করে, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ পদ্ধতি। আবার ছোট সিলিন্ডার থেকেও গ্যাস নিয়ে অন্য খালি সিলিন্ডার পূর্ণ করে সে। এ ঝুঁকিপূর্ণ পদ্ধতিতে গ্যাস স্থানান্তর করতে গিয়ে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে দেশ জুড়ে। পটিয়ায় সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ৫ জন দগ্ধ হওয়া ছাড়াও এর আগে চন্দনাইশ, কর্ণফুলী ও লোহাগাড়ায় হতাহতের অনেক ঘটনা ঘটে।

ফজলু কাদেরর সিলিন্ডার প্রতারণা নিয়ে চট্টগ্রাম জুড়ে লঙ্কাকাণ্ড ঘটলেও প্রশাসনের কর্মমকর্তারা কিছুই জানে না । সবই চলে প্রশাসনের অগোচরে। তাই এ ব্যাপারে সকালের-সময়কে একদম সোজা সাপটা কথাই বললেন পুলিশের এক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, আমরা সব সময় এসব বিষয়ে সক্রিয় থাকার চেষ্টা করি। এমন বিষয়ে আমার জানা ছিলো না। আমি খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করছি।

এ বিষয়ে চট্টগ্রামের সহকারী বিস্ফোরক পরিদর্শক মুহাম্মাদ মেহেদী ইসলাম খান সকালের-সময়কে বলেন, বাংলাদেশে মাত্র পাঁচ-সাতটি স্থানে বৈধভাবে গ্যাস ক্রস ফিলিংয়ের সুযোগ রয়েছে। চট্টগ্রামে তিনটি প্ল্যান্ট বসানোর কাজ চলমান। প্ল্যান্ট ছাড়া এ ধরনের ক্রস ফিলিংয়ের কোনো সুযোগ নেই। তবে কিছু অসাধু চক্র গ্রাহকদের সরলতার সুযোগ নিয়ে অবৈধভাবে গ্যাস ক্রস ফিলিং করে চলেছে। এতে গ্রাহকদের ঠকাচ্ছে আবার নিজেরাও দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে।

তিনি আরো জানান, চলতি বছরের শুরুতে খাগড়াছড়ির খবংপুড়িয়া গ্রামে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ৭ জন নিহত হওয়ার ঘটনাকে প্রথমে স্বাভাবিক দুর্ঘটনা মনে করা হলেও বিস্ফোরক পরিদফতরের বিশেষ প্রতিনিধি দলের তদন্তে জানা যায়, অবৈধভাবে বড় সিলিন্ডার থেকে ছোট সিলিন্ডারে গ্যাস সরবরাহ করতে গিয়ে ঘরে গ্যাস জমে গিয়েছিল। পরে বিদ্যুতের সুইচ দিলে বিস্ফোরণ ঘটে।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোঃ ইলিয়াছ হোসেন বলেন, হামজারবাগ গাউসিয়া আবাসিকের ফজলু কদেরের অবৈধভাবে গ্যাস ‘ক্রস ফিলিং’র অভিযোগ আপনার মাধ্যমেই আবার নতুন করে পেলাম। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখে তার ব্যাপারে যতাযত ব্যাবস্থা নিব। আইনে এ ধরনের অপরাধে সর্বোচ্চ ৫ বছরের সাজা জরিমানার বিধান রয়েছে।

এ ব্যাপারে র‍্যাব ৭ এর অধিনায়ক সকালের সময়কে বলেন, সিলিন্ডার গ্যাস ক্রস ফিলিং একটা ভয়াবহ মারাত্মক কাজ, এই কাজের সাথে যত প্রভাবশালীই জড়িত থাকুক, আমরা তাদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিব।

ফজলু কাদের ওমেরা ৩৫ কেজি, বিএম ৩৩ কেজি নাভানা ৩৪ কেজি গ্যাস সিলিন্ডার থেকে গ্যাস ক্রস ফিলিং করে ছোট ১২ কেজি গ্যাস বোতলে ভর্তি করে। তার কাছে নেই কর্তৃপক্ষের কোন ধরণের ছাড়পত্র। ৬/৭ জন কর্মচারী দিয়ে বিকেল ৪টা থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত এসব প্রতারণা করে সে। তার দু’টা ছোট পিক আপে করে পুরো চট্টগ্রাম শহরে সে তার জাল-জালিয়াতির গ্যাস ব্যবসা করে যাচ্ছে।

প্রিয় পাঠক! ফজলু কাদেরের আরো চাঞ্চল্যকর প্রতারণার তথ্য জানতে আগামী পর্বে চোঁখ রাখুন।

আরো সংবাদ