বেরিয়ে আসছে থলের বিড়াল

তিন কর্তার ইচ্ছেই ঘুরেফিরে কাজ পায় পছন্দের ঠিকাদার—ভাগাভাগি!


মোহাম্মদ ফোরকান  ২ জুন, ২০২৪ ১:৪৮ : পূর্বাহ্ণ

সরকারী ক্রয় কার্যক্রমে ঠিকাদার বাছাই করার জন্য উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতি সবচেয়ে গ্রহনযোগ্য পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত হয়। এর মাধ্যমে অধিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে থেকে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় সার্বিক বিবেচনায় সবচেয়ে যোগ্য ঠিকাদার, সরবরাহকারী বা কনসালটেন্ট খুঁজে বের করা হয়।

পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ২০০৬ সনের ২৪নং আইনে বলা হয়েছে সরকারী তহবিলের অর্থ দ্বারা কোন পণ্য, কার্য বা সেবা ক্রয়ের ক্ষেত্রে যে বিষগুলো লক্ষ্য রাখতে হবে তা হল—স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, ক্রয়কার্যে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক সকল ব্যক্তির প্রতি সম-আচরণ, অবাধ প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা, অনুসরণীয় পদ্ধতি নির্ধারণসহ আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে বিধান করা।

কিন্তু ঠিকাদারদের অভিযোগ—চট্টগ্রাম মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের এর কর্মকর্তারা এই আইন মানতে নারাজ, তারা উন্মুক্ত দরপত্র পদ্বতি (ওটিএম) মাধ্যমে দরপত্র আহ্বান করলেও সেই দরপত্রের কাজ তাদের নিদিষ্ট ঠিকাদার ছাড়া অন্য কেউ পায় না।

জানা যায়, চট্টগ্রামের মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড সম্প্রতি উন্মুক্ত দরপত্র পদ্বতি (ওটিএম) মাধ্যমে একটি দরপত্র আহ্বান করেন। নিয়ম অনুযায়ি দরপত্রে যেসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অংশ গ্রহণ করবে, ওই প্রতিষ্ঠানগুলো শিডিউলের মোট মূল্যের অংকের ১০ ভাগ অর্থ কম বা বেশি দেখিয়ে দরপত্র দাখিল করে থাকেন।

কিন্তু—সেখানে পছন্দের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে দরপত্রের কাজটি পাইয়ে দিতে গোপন করা হয় শিডিউলের প্রকৃত মোট মূল্যের অংকের পরিমাণ। এতে শিডিউল মোট মূল্যের অংকের ১০ ভাগ অর্থ কম বা বেশি দেখিয়ে দরপত্র দাখিল করেও কাজ পাচ্ছে না বহু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কর্মকর্তাদের কৌশলের ফাঁদে পড়ে টাকা খরচ করে শিডিউল কিনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ঠিকাদাররা।

অভিযোগ রয়েছে—সরকারি এই সায়িত্তশাসিত মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের টেন্ডার কমিটির চেয়ারম্যান জেনারেল ম্যানেজার (এইচআর) ইনাম ইলাহী চৌধুরী, জেনারেল ম্যানেজার (অপারেশন্স) মো. মফিজুর রহমান ও এসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার (পারচেজ) মোহাম্মদ শরিফুল ইসলাম। মূলত এই তিন কর্মকর্তার ‌‌‘কৌশলের মারপ্যাচে’ পড়ে একটি নির্দিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বারবার কাজ পেলেও বেশি ভাগ প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এভাবে পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে দরপত্রের কাজ পাইয়ে দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন তারা।

চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে টেন্ডারের কাজ পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ এনে মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড চট্টগ্রামের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. টিপু সুলতানের বরাবরে চিঠি দিয়েছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ফারদিন বিল্ডার্সের স্বত্বাধিকারী মেহেদী হাসান সুমন। এছাড়া জেনারেল ম্যানেজার ( অপারেশন্স) মো. মফিজুর রহমান ও এসিস্ট্যান্ট জেনালে ম্যানেজার (পারচেজ) মোহাম্মদ শরিফুল ইসলামকে ওই চিঠির অনুলিপি পাঠানো হয়।

ওই চিঠিতে বলা হয়—ঝালকাঠী ডিপোর পার নম্বর ০৪২ (২০২৩-২০২৪), টেন্ডার আইডি নম্বর ৯০০২৮৯। মেঘনা পেট্রোলিয়ামের লিমিটেড বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে দেওয়া দরপত্রে ঝালকাঠী ডিপোতে আরসিসি ফুটপাত, ড্রেন, ট্যাংকের চারপাশে ওয়ার্কওয়ে ও বৈদ্যুতিক মিটার রুম হস্তান্তর সহ অন্যান্য কাজের দরপত্রে অংশ করে ফারদিন বিল্ডার্স।

তিনি বলেন, কর্তৃপক্ষের ওটিএম এর নিয়ম অনুযায়ি মোট মূল্যের মধ্যে দরপত্র দাখিল করা হয়। দরপত্রের মোট মূল্য দেখানো হয় ৫২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সেখানে ওই মোট মূল্যের অংকের হিসাব থেকে ১০% নিম্নে দরপত্র দাখিল করা হয়। কিন্তু দরপত্র খোলার পর দেখতে পায় কর্তৃপক্ষের অফিশিয়াল দরপত্রের মোট মূল্য ছিল ৫২ লাখ ৭৭ হাজার ৪৯ টাকা। সেখানে দরপত্রের প্রকৃত হিসাব আগে থেকে জেনে যাওয়ায় মোট মূল্য হিসাব থেকে ১০% কম দিয়ে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে কাজটি পেয়েছে টি.এস এন্টারপ্রাইজ।

চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়—আমরা বারবার দরপত্রে অংশ করে কাজ পাচ্ছিনা। যেসব প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে কতিপয় অসাধু কর্মকর্তারা যোগসাজশ করে তাদেরকে দরপত্রের অফিশিয়াল প্রকৃত মোট মূল্য বলে দেওয়া হয়। এসব অসাধু কর্মকর্তাদের দুটি পছন্দের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেগুলো হল- টি.এস এন্টারপ্রাইজ ও সূ-কন্যা এন্টারপ্রাইজ। এই দুই প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী একজন ব্যক্তি। প্রতিষ্ঠান দুটি গত ৫ বছর ধরে অনেক কাজ করেছে।

এসব তথ্যের সত্যতা হিসেবে মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের চট্টগ্রামের এজিএম পারচেজ সেকশনের ফাইল দেখলে তার প্রমাণ মেলবে। এতে আমার হাজার হাজার টাকা খরচ করে তাদের কৌশলের কারণে দরপত্র অংশ গ্রহণ করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। ওটিএম না করে ওএসটিইটিএম পদ্ধতিতে নতুনভাবে ওই দরপত্রটি আহ্বান করার অনুরোধ করা হয় ওই চিঠিতে।

জানা যায়—ওই দরপত্রটি (আইডি নম্বর ৯০০২৮৯) গত মাসে দরপত্র খোলা হয়েছে। দরপত্রটি খুললে পেয়ে যায় তাদের পছন্দের প্রতিষ্ঠান টি.এস এন্টারপ্রাইজ।

এদিকে চলতি বছরের এপ্রিলে আবারও পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে একইদিনে পৃথকভাবে দুটি দরপত্র দেয় মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড। ওই দরপত্রের শেষ সময় দেয় চলতি বছরের ২১ এপ্রিল। ওই দরপত্রে ওএসটিইটিএম পদ্ধতিতে দুটি কাজের আহ্বান করা হয়। একটি বরিশাল (টেন্ডার নম্বর ৯৫৮৫৭৯) অপরটি ঢাকায় (টেন্ডার নম্বর ৯৫৮৫৭১)। এই দুটি দরপত্র খোলা হয় চলতি বছরের ২২ এপ্রিলে। দুটি দরপত্র হল কনস্ট্রাকশন কাজ। একইদিনে পৃথকভাবে আরও একটি কনস্ট্রাকশন কাজ চট্টগ্রামে ওটিএম করে দরপত্রে আহ্বান করা হয়। যার দরপত্র নম্বর ৯৬৫৩১৮ পিইউআর-১২৮।

অভিযোগ রয়েছে—পছন্দের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে ওই কাজটি পাইয়ে দিতে একইদিনে তিনটি কনস্ট্রাকশন কাজের দরপত্র আহ্বান করে চট্টগ্রামের মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড। পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এই তিনটি কাজের মধ্যে দুটি কাজ দিয়েছে ওএসটিইটিএম পদ্ধতিতে এবং পৃথক বিজ্ঞপ্তিতে একটি দিয়েছে ওটিএম পদ্ধতিতে। মূলত তাদের পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে দরপত্রের কাজটি হাতে তুলে দিতে ওটিএম পদ্ধতিতে আশ্রয় নেয়া হচ্ছে তাদের কৌশল।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের জিএম (অপারেশন্স) মো. মফিজুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কল রিসিভ করেনি।

পরবর্তীতে ডিজিএম (অপারেশন্স) মো. মুজিবুর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি
তিনি ম্যানেজার পারচেজ এর সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য বলেন।

এই বিষয়ে টেন্ডার কমিটির চেয়ারম্যান মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের জিএম (এইচআর) মো. ইনাম ইলাহী চৌধুরীর মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে সংযোগ পাওয়া যায়নি।

এই বিষয়ে জানতে মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের এমডি মো. টিপু সুলতানের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কল কেটে দিয়ে ‘প্লিজ টেক্স মি’ দিয়ে এসএমএস দেন। পরে উপরোক্ত অভিযোগের ব্যাপারে এসএমএসে জানতে চাইলে তিনি কোনো সদুত্তর না দিয়ে অফিসে যেতে বলেন।

সকালের-সময়/এমএফ

আরো সংবাদ