সমাজের অনগ্রসর দরিদ্র, বঞ্চিত, সমস্যাগ্রস্থ জনগোষ্ঠীর কল্যাণ সাধন এবং তাদের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে সামাজিক উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তা প্রদানের লক্ষে দেশের প্রত্যেক জেলায় একটি করে সমাজসেবা কার্যালয় রয়েছে। এরমধ্যে চট্টগ্রামও রয়েছে একটি। এই অফিসের অধিনে ৫৪টি খাতে সমাজসেবা কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে।
কিন্তু—চট্টগ্রাম জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক ফরিদুল আলম, সহকারী পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) মোহাম্মদ ওয়াহিদুল আলম, সহকারী পরিচালক শাহনাজ পারভীন (কার্যক্রম) এর বিরুদ্ধে এই ৫৪ প্রকল্পগুলো থেকে সরকারি বরাদ্ধের অর্থ আত্মসাতসহ নানাবিধ অনিয়ন-দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে।
তথ্য সূত্রে জানা যায়, বছরের পর বছর বছর এই দপ্তরে অনিয়ম-দুর্নীতি দেদারছে চললেও মাথাব্যথা নেই কারও। ২০২২ সালের ৪ জুলাই থেকে চট্টগ্রাম জেলা সমাজসেবা অফিসে উপ-পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন ফরিদুল আলম। সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ ওয়াহিদুল আলম ও ঘুরেফিরে এখানে আছেন প্রায় ১০ বছর যাবৎ। যার কারণে তাদের প্রভাব আর আধিপত্যর কাছে সবাই অসহায় হয়ে পড়েছে।
জানা যায়, সমাজসেবায় সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প থেকে সুবিধাভোগিদের ভুয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে প্রশিক্ষণ নেওয়া ব্যক্তিদের আড়ালে প্রতি বছর উপ-পরিচালক, সহকারী পরিচালকরাসহ এই দপ্তরের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলে আত্মসাৎ করেছেন কোটি কোটি টাকা। একই সময়ে উপকারভোগীর তালিকায় নাম আছে, কিন্তু প্রশিক্ষণ পাননি, এমন ব্যক্তিদের আড়ালে আত্মসাৎ করা হয়েছে আরও লাখ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে বছর শেষে চট্টগ্রাম জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক, সহকারী পরিচালক মিলে আত্মসাৎ করেন কোটি কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কাগজে-কলমে উপকারভোগীরা কামার, কুমার, নাপিত, কেউবা বাঁশ-বেতের পণ্য প্রস্তুতকারী। তবে বাস্তবে এসব পেশায় যুক্ত নন তাঁরা। মূলত দেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর পেশাজীবীদের জন্য বরাদ্দ থাকা উদ্যোক্তা মূলধন ও প্রশিক্ষণ ভাতা আত্মসাৎ করতে এমন ভুয়া পেশাজীবী বানানো হয়েছে তাঁদের। সমাজসেবা অধিদপ্তরের ‘প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন’ প্রকল্পে এমন অনিয়ম-দুর্নীতি হলেও দেখার কেউ নেই।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রকল্পের আওতায় ক্ষেত্রবিশেষে কেউ কেউ ভুয়া নাম-ঠিকানার আড়ালে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে, ধনী ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, বিভিন্ন দলের নেতা, পাতি নেতা এবং উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের কর্মচারীদের পরিবারের সদস্য নিজেদের প্রান্তিক পেশাজীবী হিসেবে প্রশিক্ষণ দেখিয়ে আত্মসাৎ করা হচ্ছে সরকারি অর্থ।
আরও জানা যায়, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থাসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনকে নিবন্ধন প্রদানে তদারকি না করে মোটা অংকের ঘুষের মাধ্যমে তারা নিবন্ধন দিচ্ছে। কাগজ কলমে বিভিন্ন প্রকল্পের নাম ব্যবহার করে উপ-পরিচালকের সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট মিলে ভাগ বাটোয়ারা করেছেন সরকারের লাখ লাখ টাকা। এ ব্যাপারে দূর্নীতি দমন কমিশনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছেন, উল্লিখিত প্রকল্প ছাড়াও চট্টগ্রাম জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের অধীনে জেলার অবহেলিত হিজড়া গোষ্ঠি ও দলিত হরিজন গোষ্ঠিদের প্রশিক্ষন বাবদ ও তাদের জীবন যাত্রার মান উন্নয়নে হিজড়াদের বিউটি পার্লার ও দর্জি আর দলিত হরিজন ব্যক্তিদের কম্পিউটার ও দর্জি প্রশিক্ষন দিয়ে
নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর টার্গেট নিয়ে সরকার প্রতিবছর বিভিন্ন বিষয়ের উপর প্রশিক্ষনের আয়োজন করেন। এই প্রকল্প থেকেও সরকারের লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন উপ-পরিচালক–সহকারী পরিচালক ও তাদের সিণ্ডিকেট।
এদিকে যে ৫৪ খাতগুলো থেকে টাকা আত্মসাত করেন তার মধ্যে অন্যতম হলো নিচের খাতগুলো—যেমন পল্লী সমাজসেবা কার্যক্রম (সুদমুক্ত ক্ষুদ্রঋণ), পল্লী মাতৃকেন্দ্র কার্যক্রম, এসিডদগ্ধ ও প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন কার্যক্রম, শহর সমাজসেবা কার্যক্রম (সুদমুক্ত ক্ষুদ্রঋণ ও দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ), আশ্রয়ণ কার্যক্রম, বয়স্ক ভাতা কার্যক্রম, অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা কার্যক্রম, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তি, মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা, সরকারী শিশু পরিবারে এতিম শিশু প্রতিপালন ও পুনর্বাসন, ছোটমণি নিবাসে শিশু প্রতিপালন ও পুনর্বাসন, বিপন্ন শিশুদের সুরক্ষা কার্যক্রম, প্রতিবন্ধিতা সনাক্তকরণ, পরিচয় পত্র ও সনদ ইস্যু, দৃষ্টি ও বাক-শ্রবণ প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় পরিচালনা, প্রবেশন ও আফটার কেয়ার কর্মসূচী বাস্তবায়ন, হাসপাতাল সমাজসেবা কার্যক্রম, মহিলা ও শিশু কিশোরী হেফাজতিদের নিরাপদ আবাসন (সেফহোম), আর্থ সামাজিক ও দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ, স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ মূলক সংস্থা নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ, বেসরকারী এতিমখানায় ক্যাপিটেশন গ্রান্ট প্রদান, নিবন্ধিত সংস্থাসমূহে আর্থিক অনুদান প্রদান, অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতা, শিশু সুরক্ষা হেল্পলাইন ১০৯৮, সমাজকল্যাণ পরিষদের আর্থিক অনুদান বিতরণ, রোগী কল্যাণ সমিতি থেকে অসচ্ছল রোগীদের চিকিৎসা সহায়তা, কৃত্রিম অঙ্গ ও প্রতিবন্ধী সহায়ক উপকরণ বিতরণ, বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস উদযাপন, হিজরা জনগোষ্টির জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচী ও উপবৃত্তি, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টী পরিবারে আর্থিক অনুদান ও শিক্ষা উপবৃত্তি, ক্যান্সার, কিডনি ও লিভার সিরোসিস এককালীন চিকিৎসা সহায়তা, মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতিষ্ঠান, সরকারী আশ্রয়কেন্দ্র পরিচালনা, এতিম ও দুঃস্থ শিশুদের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, চা শ্রমিকদের অনুদান বিতরণ, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্টীর জীবনমান উন্নয়ন কার্যক্রম, ভিক্ষুক পুনর্বাসন কর্মসূচী, এনডিডি ও অটিজম ব্যক্তিদের চিকিৎসা সহায়তা ও স্কুলিং, ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট কর্মসূচী থেকে সর্বশেষ শেখ রাসেল দুস্থ শিশু প্রশিক্ষণ ও পুর্নবাসন কেন্দ্র।
সূত্রগুলো জানিয়েছেন, ৫৪টি প্রকল্প থেকে এভাবেই চট্টগ্রাম জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক ও সহকারী পরিচালকরা ও তাদের সিণ্ডিকেট লুট করে যাচ্ছেন সরকারি অর্থ। তাদের এসব ভয়াবহ অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
তারা জানান, উপ-পরিচালক ও সহকারী পরিচালকের অনিয়ম-দুর্নীতি এখানে নতুন নয়। এখানে যারাই আসেন তারাই জড়িয়ে পড়েন অনিয়ম-দুর্নীতিতে এই যেন এক মগের মুল্লুকে বাস করছি। উপ-পরিচালক ও সহকারী পরিচালকদের ক্ষমতা, দাপট, আধিপত্য এখানে লেগেই থাকে। তাদের বিরুদ্ধে অফিসের কেউ কথা বলতে সাহস পায়না। কথা বললেই হতে হয় নানাবিধ হয়রানি ও হুমকি-ধমকির শিকার।
অনিয়ম দুর্নীতির ব্যাপারে জানতে সরাসরি মুরাদপুর জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ে গিয়েও উপ-পরিচালক ফরিদুল আলমের দেখা মেলেনি। পরে মোবাইল ফোনে কল আর হোয়াটসঅ্যাপে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এদিকে এই দপ্তরের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ ওয়াহিদুল আলমের সঙ্গে অফিসে গিয়ে সরাসরি যোগাযোগ করা হলে তিনিও তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক ও সহকারী পরিচালকের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে জানতে দক্ষিণ খুলশি বিভাগীয় সমাজসেবা পরিচালকের অফিসে গেলে তারও সাক্ষাৎ মেলেনি।
এসএস/এমএফ