চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ১৩ নং পাহাড়তলী ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ হোসেন হীরন দীর্ঘদিন ধরে নগরীর পাহাড়তলী থানার সেগুনবাগান এলাকায় রেলের জায়গা দখল করে সেখানে তিনি অবৈধভাবে গড়ে তুলেছে এসফল্ট প্ল্যান্ট।
রেলওয়ের বাংলো, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসিক ভবনের চতুর্দিকের জমিও দখলে নিয়েছেন হিরণ। আর দখলকৃত এসব জায়গা প্রতিগণ্ডা ৫ থেকে ১০লাখ টাকায় দখলস্বত্ব বিক্রি করছেন তিনি!
অভিযোগ ওঠেছে, রেলওয়ের জায়গা দখলের সঙ্গে মোহাম্মদ হোসেন হিরণসহ অনেকে জড়িত। সরকারি দলের পাহাড়তলী ও খুলশী এলাকার বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে ভূ-সম্পত্তি বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যৌথ সিন্ডিকেটে চলছে জায়গা দখলের ‘মহোৎসব’।
স্থানীয়রা অভিযোগ করে জানায়, ওয়ার্ড কাউন্সিলর হিরণ বিভিন্নভাবে প্রভাব খাটিয়ে রেলের অনেক জায়গা অবৈধভাবে দখলে রেখেছেন। রেলের এসব জমিতে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা দোকানপাট, ভাড়া বাড়ি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অফিস, সিএনজি ট্যাক্সি ও রিকশার গ্যারেজ নেপথ্যে থেকেই পরিচালনা করছেন তিনি।
সরেজমিনে শনিবার পাহাড়তলী ও খুলশী এলাকা ঘুরে রেলওয়ের জায়গা দখলের বিভিন্ন চিত্র দেখা যায়। ওই এলাকায় বসবাসকারী রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেশ কয়েকজনের সঙ্গে প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁরা জানান, গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর থেকে পাহাড়তলী ওয়ার্ডের আমবাগান, ঝাউতলা, সেগুনবাগানের ‘এ-১’, ‘এ-২’ ও ‘এ-৩’ এর পেছনে বাগানবাড়িতে কয়েক একর জায়গা দখল হয়েছে।
রেলকর্তৃপক্ষ অবৈধ জায়গা উচ্ছেদের চেষ্টা করেছেন কিন্তু তিনি আ:লীগের সাইনবোর্ড ব্যবহার করে প্রভাব খাটিয়ে রেলওয়ের বিশাল জায়গা নামে- বেনামে দখলে রেখেছেন হিরণ! বাগানবাড়ির সামনে ‘এ-২’ ‘এ-৩’ বাংলো। এসব বাংলোতে রেলের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা পরিবার নিয়ে থাকেন। বাংলো দুটির সামনে সড়কের পাশে দেখা যায় দখলের প্রক্রিয়া। রেলওয়ের কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া কয়েক একর জায়গায় ভরাট করা হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, রেলওয়ের কর্মচারী আবুল কালাম এ জায়গা ভরাট করে দখলস্বত্ব বিক্রির চেষ্টা করছেন। স্থানীয় লোকজন কাউন্সিলরের সাথে দেখা করলে তিনি বলেন, এগুলো আমি করছি, সেখানে টয়লেট ও যাত্রী ছাউনি হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলোতে বসবাসকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কয়েকজন জানান, কাউন্সিলর হিরণ, সহকারী ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা আব্দুল বারী ও কর্মচারী আবুল কালাম এই দখল কাজে জড়িত।বিভাগীয় ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তার কার্যালয়ের অদূরে রেলের কোটি টাকার জায়গা দখলের চেষ্টা চললেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, হিরণের দখল করা জমির মধ্যে বিভিন্ন ক্লাব, যুবলীগ, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের কার্যালয় গড়ে তোলা হয়েছে। রেলওয়ে ডিপ্লোমা অফিসের পাশেই গোয়ালঘর তুলে রাখা হয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে মুখ খুলতে পারছেন না রেলওয়ে কর্মকর্তারা।
জানা যায়, রেলওয়ের প্রভাবশালী কিছু কর্মচারীর সাথে ভালো সখ্যতা থাকায় জমিগুলো অবৈধ দখলে চলে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগও রয়েছে বলে জানা যায়।
এ বিষয়ে মোহাম্মদ হোসেন হিরণ সকালের-সময়কে বলেন, প্রায় ৩০ একরের উপর জায়গা দখলে রয়েছে। আপনি এসে দেখে যান, যদি লোকে বলে আমার তাহলে আমারেই! আমার আরো জায়গা দখলে ছিলো রেল আপত্তি করায় আমি ছেড়ে দিয়েছি। আপনি নিউজ করলে করতে পারেন বলে লাইন কেটে দেয়।
সম্প্রতি হিরণের অবৈধ দখলে রাখা রেলওয়ের ৫০ কোটি টাকার জমি দখলমুক্ত করেছিলো রেল কর্তৃপক্ষ। তখন অভিযান চালিয়ে দুই একর জায়গা দখলমুক্ত করেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা ইশরাত রেজা। তার সাথে ছিলেন, তখন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আফজাল হোসেন ও রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সহকারী ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা আব্দুল বারী।
এ বিষয়ে ইশরাত রেজা জানান, রেলের জায়গায় অবৈধভাবে এসফল্ট প্ল্যান্ট তৈরি করেছিল একটি প্রতিষ্ঠান। ওই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ১৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেন হিরণ। রেলের জায়গায় অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এসফল্ট প্ল্যান্টের কারণে এলাকার পরিবেশ দূষণসহ নানা সমস্যা দেখা দেয়। এতে রেলের দুই একর জায়গা বেদখল হয়ে যায়। এছাড়া মেশিনের শব্দ ও বিটুমিন পড়ে এলাকার পরিবেশ দূষণ করে হিরণ।
হিরণ এখন আ:লীগের সংসদ সদস্য আফছারুল আমিনের অনুসারী বলে পরিচিত এলাকায়, খোদ এমপিও এই কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে সরব রয়েছেন। এমপি’র অভিযোগ- কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেন হিরণের দাপটে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা অসহায় হয়ে পড়েছেন। স্বাভাবিকভাবে দলীয় কর্মকাণ্ড করতে পারছেন না তারা। তৃণমূলের নেতাদের বরাত দিয়ে কাউন্সিলর হিরণের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি তুলেছেন তিনি।
সম্প্রতি (১০ জুলাই) চট্টগ্রাম নগরীর থিয়েটার ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যনিবাহী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। দীর্ঘদিন পর নগর কমিটির সহ-সভাপতি হিসেবে সাংগঠনিক ওই সভায় যোগ দিয়ে আফছারুল আমিন কাউন্সিলর হিরুণের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেন।
মোহাম্মদ হোসেন হিরণ সংসদ সদস্য আফছারুলের সংসদীয় আসনের অধীন চট্টগ্রাম নগরীর ১৩ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। তিনি খুলশী থানা আওয়ামী লীগের আহ্বায়কের দায়িত্বও পালন করছেন। খুলশীজুড়ে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারকারী তিনবারের কাউন্সিলর হিরণ প্রয়াত মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী ছিলেন।
আফছারুল আমিন মন্ত্রিত্ব পাওয়ার পর তার সঙ্গে ভেড়েন তিনি। ২০১৯ সালের সংসদ নির্বাচনের পর আফছারুলের সঙ্গে হিরণের দূরত্ব তৈরি হয়েছে বলে আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।