নায়েবুল ইসলাম ফটিক চট্টগ্রাম বন্দরের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী এক সিবিএ নেতা। কর্মরত আছেন নৌ বিভাগের লস্কর পদে। পাশাপাশি করেন ঠিকাদারী ব্যবসা, দীর্ঘ সময় চাকরির সুবাদে দুর্নীতিবাজ সাবেক বন্দর চেয়ারম্যান ও সচিবের সাথে সখ্যতা গড়ে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি, বন্দর নিয়ন্ত্রণ, টেন্ডার বাণিজ্য, স্ক্র্যাপ বাণিজ্য, কেনাকাটা নিয়ন্ত্রণ, নিয়োগ বাণিজ্য, কর্মস্থলে প্রভাব, সিবিএ নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে জায়গা-জমি, ফ্ল্যাট-প্লটসহ গড়েছেন অঢেল সম্পদ।
তিনি চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক চেয়ারম্যান (কারাবন্দী) রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল এর অত্যন্ত আস্থাভাজন। তার প্রভাবেই চট্টগ্রাম বন্দরে করতেন নানা অপকর্ম। সোহায়েলের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, জোরপূর্বক গুম-হত্যাসহ নানা অভিযোগে তাকে সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আটক করে শ্রীঘরে পাঠালেও তার সহযোগী খ্যাত এই সিবিএ নেতা এখনো অধরা। যাকে এখনো নানাভাবে বিভিন্ন অপকর্মে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগীতা করছেন খোদ বন্দর সচিব নিজেও।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নায়েবুল ইসলাম ফটিক ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচার সরকার আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তিনি চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন বিভাগে প্রভাব বিস্তারের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতাদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলে নিজেকে প্রভাবশালী সিবিএ নেতা হিসেবে জাহির করেন। এরপর বন্দর কর্মকর্তাদের তাদের ভয়-ভীতি দেখিয়ে কাজ হাতিয়ে নিতেন। এতে করে তিনি শত শত কোটি টাকার কুমির বনে গেছেন। বন্দরের একচেটিয়া ঠিকাদারি ব্যবসাও এখন তার সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে।
ইতিপূর্বে ফটিক ও তার সিণ্ডিকেটের বিরুদ্ধে নানা অপকর্ম, আধিপত্য ও অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে গত ১১ জানুয়ারি দুদকেও হয়েছে অভিযোগ। এরপর নজরদারিতে রেখেছে দুর্নীতি দমন কমিশনও। তাদের গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হলেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। বন্দরের এই মাফিয়া সিণ্ডিকেট ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় হুমকির মুখে পড়েছে চট্টগ্রাম বন্দর।
তবে এই সিবিএ নেতার একটি শক্তিশালী বাহিনী রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরে, যারা ফটিকের নির্দেশে বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িত, তারা হলেন–সিবিএ’র সহ-সভাপতি খন্দকার মোহাম্মদ ইয়াকুব, শ্রমিক নেতা সাইফুর রহমান সোহেল, জসিম উদ্দীন জনি, মাহাবুবুর রহমান লিংকন, ইমান উদ্দীন রনি, রমজান আলী, আল-আমিন, ছাত্রলীগ নেতা মাসুম, সরফুদ্দীন বাবু, রেহমান রাব্বী, আবির, পিয়াস, নাঈম, শাহাবুদ্দীন সাবু, জিসান, জাবেদ সহ আরও অনেকে।
বন্দর সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দর কর্মচারী পরিষদ ( সিবিএ, রেজিষ্ট্রেশন নম্বর-২৫৩৯) পুরোটায় এখন নিয়ন্ত্রণ করেন ফটিক সিণ্ডিকেট। তার প্রভাব আর আধিপত্যর কাছে পুরো বন্দর অসহায়। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, প্রতিবাদকারীদের চাকরিচ্যুত, হুমকি-ধমকির অভিযোগ দীর্ঘদিনের, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পরও ফটিক ও তার সিণ্ডিকেট এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছে।
তথ্যসূত্রে জানা যায়, ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশে জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার পর সরকার গেজেট প্রকাশ করে চট্টগ্রাম বন্দরের সকল ইউনিয়নের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে। পরে সরকারি নির্দেশে ২০১০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দর কর্মচারী পরিষদ সিবিএ গঠন করা হয়। ২৫ সদস্য বিশিষ্ট এ পরিষদের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয় ২ বছর। কিন্তু ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সিবিএ নির্বাচনের মেয়াদ শেষ হলেও প্রায় এক যুগ ফটিকের একক নিয়ন্ত্রণে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
জানা যায়, মেয়াদ উত্তীর্ণ কমিটি হওয়ার পরও সম্পূর্ণ বেআইনীভাবে ক্ষমতায় থেকে বন্দরে নিয়োগ, বদলী, বাসা বরাদ্দের নামে অর্থ আদায় করেন সিবিএ’র সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নায়বুল ইসলাম ফটিক। সাধারণ শ্রমিকরা তাদের এসব অবৈধ কর্মকাণ্ডের যারা বিরোধিতা করছেন, তাদেরকে নানা ভাবে চাকুরিচ্যুত, বদলি, হয়রানি এমনকি বাসা থেকে উচ্ছেদ পর্যন্ত করেছেন তারা। যা এখনো পর্যন্ত চলমান আছে। তাদের কর্মকাণ্ডে এখন সরকারের ভাবমূর্তির পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দরের ভাবমূর্তি চরমভাবে বিনষ্ট করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হয়রানির শিকার এমন চট্টগ্রাম বন্দরের কয়েকজন কর্মচারী বলেন, গঠনতন্ত্রে থাকলেও মেয়াদ শেষের এক বছর পর নির্বাচন দেওয়ার নিয়ম তাকলেও আজ এক যুগ পার হয়ে গেছে। বর্তমানে দুর্নীতিবাজ-চাঁদাবাজ এই ফটিক ও সিবিএ নেতারা চাকরি ও বাসা বরাদ্দের নামে ঘুষ বাণিজ্য করছেন। আর যারা এর প্রতিবাদ করছেন তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার পাশিপাশি নানা ভাবে হয়রানি করছেন।
নানা অনিয়ম-দুর্নীতির দায়ে সম্প্রতি নায়েবুল ইসলাম ফটিক, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের হারবার মাস্টারসহ পাঁচ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে তলব করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে তাদেরকে সশরীরে হাজির হয়ে নিজ, স্ত্রী, সন্তানদের জাতীয় পরিচয়পত্রসহ তাদের নামে থাকা স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের বিবরণী, দলিল ও প্রমাণাদি দাখিলের নির্দেশ দিয়েছে দুদক চট্টগ্রাম।
এই পাঁচজন হলেন—চট্টগ্রাম বন্দরের নৌ বিভাগের হারবার মাস্টার ক্যাপ্টেন জহিরুল ইসলাম, নৌ বিভাগের সহকারী জাহাজ পরিদর্শক দেলোয়ার হোসেন, সিবিএর ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নায়েবুল ইসলাম ফটিক, নৌ বিভাগের প্রথম শ্রেণির মাস্টার ইব্রাহিম সেলিম ও ট্রাফিক বিভাগের ওয়ানস্টপ সার্ভিস সেন্টারের সহকারী পরিবহন পরিদর্শক সাইফুল ইসলাম রনিসহ এই পাঁচ জনের বিরুদ্ধে একটা দুর্নীতির অভিযোগ হয়েছিল, এখন অভিযোগটি কোন পর্যায়ে আছে এই বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য বন্দর সচিব ওমর ফারুককে কল দেওয়া হলে তিনি কল রিসিভ করেনি।
দুদকের উপ-পরিচালক মো. আতিকুল আলম বলেন, ‘আমাদের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে তারা হাজির হয়ে কাগজ জমা দিয়ে তাদের বক্তব্য দিয়েছেন। আমরা প্রাথমিক অনুসন্ধান শুরু করেছি। এর বেশি কিছু তদন্তের স্বার্থে বলতে পারবো না।
তবে নিয়োগ বাণিজ্য, কর্মস্থলে প্রভাব, অনিয়ম-দুর্নীতি করে সম্পদের পাহাড়গড়াসহ নানান অভিযোগ জানার জন্য নায়েবুল ইসলাম ফটিকের মোবাইল নাম্বারে কল ও হোয়াটসঅ্যাপে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও তার সারা মেলেনি।
তবে নাম প্রকাশ না করে বন্দরের একাধিক সিবিএ নেতা জানান, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হলেও তিনি সাধারণ সম্পাদক হিসাবেই একছত্র আধিপত্য বিস্তার করছেন বন্দরে ভবন ও আশপাশের এলাকাতে। সাধারণ সম্পাদক মো. রফিউদ্দিন খান ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর থেকে অবসরোত্তর ছুটিতে গেছেন। এতে সিবিএর সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক মো. নায়েবুল ইসলাম (ফটিক) দায়িত্ব পান সাধারণ সম্পাদকের। মেয়াদ পেরিয়ে গেলেও সিবিএর নির্বাচন না হওয়ার সুযোগ নিয়ে তিনি রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন।
জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দের একচেটিয়া ঠিকাদারি, আধিপত্য ধরে রাখতে আদালতের নির্দেশনা ও শ্রম আইনের তোয়াক্কা করছেন না ফটিক সেণ্ডিকেট। এমনকি নির্বাচন আয়োজনে শ্রম দপ্তরের নির্দেশনাকেও বারবার বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে চলেছেন তারা। ট্রেড ইউনিয়নের ধারা পালনের কোনো বালাই নেই তাদের মধ্যে। নির্বাচন আয়োজন করতে শ্রম দপ্তর থেকে তিনবার চিঠি দিলেও তা আমলে নেওয়া হয়নি। অন্যদিকে ক্ষমতা নেই বলে কিছু করার নেই বলে দোহাই দিচ্ছে শ্রম দপ্তর।
জানা যায়, নায়েবুল ইসলাম ফটিক ছাত্র জীবন থেকে আওয়ামীলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত, তিনি ২০১৩ সাল থেকে চাকরির পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দরে আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রভাব কাটিয়ে একচেটিয়া ঠিকাদারি ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তার গ্রামের বাড়ি ফেনীতে।
বন্দরের আধিপত্য ধরে রাখতে তিনি পরিবার নিয়ে চট্টগ্রামের বন্দর এলাকায় স্থায়ী হয়েছেন। ফটিক বন্দর থানা কমিউনিটি পুলিশিংয়ের সাধারণ সম্পাদক এবং বন্দর থানা বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক। তিনি ইতোপূর্বে চট্টগ্রাম সিটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ও মহানগর ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক ছিলেন।
এসএস/এমএফ