চট্টগ্রাম সিআরবি রেলওয়ে হাসপাতালে বাংলাদেশের বিভিন্ন ভূয়া সনদ দিয়ে বছরের পর বছর সরকারী চাকুরী করে আসছিলেন ভারতীয় নাগরিক জ্যোতি লাল নাথ। তিনি অবৈধভাবে বাংলাদেশি নাগরিক সেঁজে রেলের চাকুরীটা করে আসছিলেন সুনীল নাথ সেঁজে। হঠাৎ কর্মরত অবস্থায় সুনীল চন্দ্র লাল নাথের মৃত্যু হলে ছেলে পোষ্য হিসাবে রেলের চাকরিতে নিয়োগ পান তার ছেলে সুদাম নাথ।
জাল-জালিয়াতি ও ভুয়া সনদে অবৈধ ভারতীয় নাগরিকরা কিভাবে বাংলাদেশী সেঁজে সরকারী চাকুরীর পেলেন তা নিয়ে পূর্ব-রেলসহ সংশ্লিষ্ট মহলে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা।
জানা যায়, ৭ম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলাদেশে লেখাপড়া করার সার্টিফিকেট জাল-জালিয়াতি করে সুদাম নাথকে সিআরবি রেলওয়ে হাসপাতালের ইনডোরের ওয়ার্ড বয় এর জায়গায় বাবার পোষ্য হিসাবে বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষ থেকে চাকুরির অফার লেটার প্রদান করেন তৎকালিন বাংলাদেশ রেলওয়ের চীফ পার্সোনেল অফিসার পূর্ব মোঃ মাহফুজুর রহমান। তখন থেকে সুদাম নাথ রেলওয়ে বক্ষব্যধি হাসপাতালে ওয়ার্ড বয় হিসেবে চাকুরী করে আসছিলেন। বর্তমানে সে জুনিয়র নার্স হিসাবে প্রমোশনও পেয়েছে।
অফার লেটারে পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সুদাম নাথকে রেলওয়েতে সরাসরি নিয়োগযোগ্য ৩য়/৪র্থ শ্রেনীর শূন্য পদে নিয়োগের নিমিত্তে নীতিগত সম্মতি প্রদান করে রেল কর্তৃপক্ষ। তখন তৎকালিন জিএম (পূর্ব) সিআরবি, ১৭ জুলাই ২০১১ সালের সম-নম্বর দপ্তরাদেশের মাধ্যমে এএস ইনডোর চট্টগ্রাম, এপিও চট্টগ্রাম, এসিও চট্টগ্রাম এর সমন্বয়ে মাঠ পর্যায়ে তদন্তের জন্য গঠন করেন তদন্ত কমিটি। তখন তদন্ত কমিটি আর্থিক লেনদেন করে সুদাম নাথের পক্ষে প্রতিবেদন জিএম পূর্ব বরাবর দাখিল করেন। এর পর ১১ অক্টোবর ২০১১ সালে সম-নম্বর দপ্তরাদেশের মাধ্যমে নির্বাচনী কমিটি গঠন করে জিএম পূর্ব।
তখন নির্বাচনী কমিটির সুপারিশ জিএম পূর্ব কর্তৃক অনুমোদিত হয়। সাথে সাথে এ বিষয়টি নির্বাচন কমিটি মোটা অংকের আর্থিক সুবিধা নিয়ে ভারতীয় এই নাগরিকের চাকুরীটা নিশ্চিত করেন। কিন্তু তখন পুলিশ ভেরিফিকেশনও ভারতীয় এ নাগরিকের সঠিক তথ্য উপাত্ত কালেক্ট করতে গেলে আর্থিক লেনদেনের বিনিময়ে তা ধামাচাপা পড়ে যায়। যার কারণে ভারতীয় অবৈধ নাগরিক হয়েও সুদাম নাথ এখনো বুক ফুলিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়েতে চাকুরী করে যাচ্ছেন।
নিয়ম অনুযায়ী কারও সরকারী চাকুরী হলে, শিক্ষাগত যোগ্যতা, চরিত্র, জাতীয়তা, আত্মীয়তা সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে প্রমানসহ সকল কাগজ-পত্রের মূল কপি প্রদর্শন বাধ্যতামূলক। কিন্তু সুদাম নাথের ক্ষেত্রে কাগজ পত্র প্রদর্শনেও জাল-জালিয়াতির খবর পাওয়া গেছে।
আরও জানা যায়, যোগাযোগ মন্ত্রানালয় এবং মহা পরিচালকের দপ্তরে দাখিলকৃত আবেদন পত্র, সংযুক্ত সনদপত্রসমুহে ভবিষ্যত কোন ধরনের অনিয়ম পরিলক্ষিত হলে রেলওয়ে আইন ইএন্ডডি রুল/১৯৬১ এর ৪(৪) ধারার আওতায় এলে এই নিয়োগ বাতিল হবে। তাহলে সুদাম নাথ ও তার বাবা কি ভাবে রেলে চাকুরী পেলেন তা এক মাত্র রেল কর্তৃপক্ষই জানে?
জানা যায়, জ্যোতি লাল নাথ বাংলাদেশে এসে ভাইয়ের নাম সুনীল নাথ ব্যবহার করে বাংলাদেশ রেলওয়েতে চাকুরী নেয় এবং চাকুরী করতে থাকে। ঐ সময় আসল সুনীল নাথ রেলের চাকুরী ছেড়ে দিয়ে কুয়েতে চলে গেলে তখন কৌশলে জ্যোতি লাল নাথ রেলওয়েতে চাকুরী করে সুনীল নাথ নাম ব্যবহার করে। আর একই সময় ভারতে আসা যাওয়া করার জন্য আসল নাম জ্যোতি লাল নাথ নামে একটি পাসর্পোট ও করে, যার পাসপোর্ট নম্বর-টি ১৪৬৯২৪।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, জ্যোতি লাল নাথের ভাইয়ের নাম সুনীল চন্দ্র নাথ ও স্ত্রী বসুধা রানী নাথ, পুত্র সুদাম নাথ ও শ্রীকৃষ্ণ নাথ ভারতে থাকা অবস্থায় ভারতের নাগরিকত্ব লাভ করে এবং সেখানের ভোটার তালিকায় তাদের নাম প্রকাশিত হয়। ভারতের নির্বাচন তালিকা ২০১৬ তে বসুধা রানী নাথের ভোটার তালিকা নম্বর ১৩২, সুদাম নাথের ভোটার তালিকা নম্বর ১৩৫ এবং তার ভাই শ্রীকৃষ্ণ নাথের ভোটার তালিকা নম্বর ১৩৪ হিসাবে পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণ নগরের দক্ষিণ সাধারন বিধান সভা নির্বাচনে নাম প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়।
ভোটার তালিকায় বসুধা রানীর স্বামীর নাম জ্যোতি লাল নাথ, ছেলে সুদাম নাথ ও শ্রীকৃষ্ণ নাথের পিতার নাম জ্যোতি লাল নাথ হিসাবে লিপি হয়। সুদাম নাথ ও শ্রীকৃষ্ণ নাথ ভারতে বসবাস করে ছোট বেলা থেকে। সুনীল চন্দ্র নাথ রেলওয়েতে চাকুরী করাকালীন মারা গেলে বসুধা রানী, সুদাম নাথ ও শ্রীকৃষ্ণ নাথ ভারত থেকে বাংলাদেশে আসে। তখন ৭ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা দেখাইয়া সুদাম নাথ পোষ্য হিসাবে রেলওয়েতে চাকুরী নেয়।
এবং তার ভাই শ্রীকৃষ্ণ নাথ বাংলাদেশে ভারতীয় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কাজ করে এবং সুদাম নাথ সিআরবি রেলওয়ে বক্ষব্যধি হাসপাতালে জুনিয়র নার্স হিসাবে বর্তমানে চাকুরী করে আসছে। কিন্তু একজন ভারতীয় নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ এমন একটি দপ্তরে সুদাম নাথ জাল জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে সিআরবি রেলওয়ে হাসপাতালে চাকুরী করে আসায় তার বিরুদ্ধে দুদক এবং সিআরবি রেলওয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নিকট লিখিত অভিযোগ করেন সুদাম নাথের কাকা শুকলাল নাথ।
বিষয়টি নিয়ে যখন রেল মহলে আলোচনার সৃষ্টি হয় তখন সুদাম নাথ তার কাকা শুকলাল নাথকে মেরে পেলার হুমকীও দেন। শুকলাল নাথ এ বিষয়ে
১০ অক্টোবর ২০১৯ কোতোয়ালি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি ও করেছেন। ডায়েরি নম্বর-১৫৩৪
এ বিষয়ে ভারতীয় নাগরিক সুদাম নাথের সঙ্গে মোঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি সকালের-সময়কে জানান, আমি কোন দেশের নাগরিক সেটা বলতে পারবো না। আমার সাথে কথা বলতে হলে চীফ মেডিকেল অফিসার (সিএমও) অনুমতি নিয়ে কথা বলতে হবে। তার বাবার নাম কি জানতে চাইলে সুদাম নাথ বলেন, আমার বাবার নাম সুনীল সে কোন দেশের নাগরিক সেটা আমার জানার বিষয় না, আমার কাছে বাংলাদেশের সব কাগজ-পত্র আছে বলেই লাইন কেটে দেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ রেলওয়ের দুইজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সকালের-সময়কে জানান, এই বিষয়টি বাংলাদেশ রেলওয়ের অশনিসংকেত। একজন বাহিরের দেশের নাগরিক কি ভাবে বাংলাদেশ রেলওয়েতে চাকুরী করছে তা তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। এবং এ ব্যাপারে যথাযত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
প্রিয় পাঠক: সুদাম নাথ ও তার পিতার জাল-জালিয়াতির আরও খবর জানতে আগামী পর্বে চোঁখ রাখুন।
সকালের-সময়/এম ফোরকান